Thank you for trying Sticky AMP!!

আশি ও নব্বইয়ের দশকে চাইম ব্যান্ডের গাওয়া তাঁর গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়

নতুন করে চাইম গঠনের কথাবার্তা চলছিল, সোমবার সন্ধ্যায় সব শেষ!

সোমবার সন্ধ্যার একটু পরেই শোনা গেল, সংগীতশিল্পী খালিদ আর নেই। হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি। অনেকেই ঘটনার সত্যতা নিয়ে এখানে–ওখানে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। ততক্ষণে মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁকে রাখা হয়েছে গ্রিন রোডের একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল জরুরি বিভাগে একটি স্ট্রেচারের ওপর রাখা, সাদা কাপড়ে ঢাকা। একজন এসে মুখের কাপড়টি তুলে ধরলেন। চোখ–মুখ দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে, শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন তিনি। দেখে একবারও মনে হচ্ছিল না, মাত্র পৃথিবী ছাড়লেন তিনি। পাশেই দাঁড়ানো তাঁর বড় বোন ও বোনের জামাই। বাক্‌রুদ্ধ। চোখ ছলছল, মুখে বিষাদের ছাপ তাঁদের। ততক্ষণে সংগীতাঙ্গনের তাঁর সাথিরা কেউ কেউ ছুটে এসেছেন।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে চাইম ব্যান্ডের গাওয়া তাঁর গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। পরে মিক্সড অ্যালবামে গাওয়া ‘কোনো কারণেই’, ‘আবার দেখা হবে’, ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’ ইত্যাদি গান তাঁকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

Also Read: বন্ধু খালিদের মৃত্যু, ফাহমিদা নবীর উপলব্ধি

তাঁর গানে যেন জাদু আছে। সেই কবেকার গান, অথচ এখনো তরুণ-তরুণীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। তাঁদের হৃদয়ে এখনো ঝড় তোলে। তাঁর গান শুনে কত তরুণ-তরুণী প্রেমে পড়েছেন, ভালোবাসায় জড়িয়েছেন। কত তরুণ-তরুণীর প্রেম ভাঙার পর তাঁর গান শুনে কেঁদেছেন, নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।  

একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে অল্প সময়েই খ্যাতি পান খালিদ, তাঁর গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে

Also Read: গোপালগঞ্জে খালিদের মরদেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সহপাঠীরা

রাত তখন ১০টার ঘরে। সেই প্রিয় শিল্পী, প্রিয় মানুষকে দেখতে ততক্ষণে বাসার নিচে সহকর্মীদের পাশাপাশি ভক্তরাও জড়ো হয়েছেন।
মৃত্যুর সংবাদে অনেকের সঙ্গে ছুটে এসেছেন দুই বোন সামিনা চৌধুরী ও ফাহমিদা নবী। ফ্ল্যাটের নিচে খালিদের নিথর দেহের পাশে বসেই চোখ মুছতে মুছতে ফাহমিদা নবী বলছিলেন, ‘খালিদ আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। তাঁর গাওয়া স্যাড রোমান্টিক গান শ্রোতাদের কীভাবে যে আবিষ্ট করে রাখে! অবাক করার মতো। কী এক প্রাণচঞ্চল মানুষ ছিল ও। আজ চলে গেল। আমি তো ভাবতেই পারছি না। কেন চলে গেল খালিদ? নক্ষত্ররা কেন এভাবে একে একে ঝরে যাচ্ছে? আমরা তো আর নিতে পারছি না। আমরা শিল্পীরা আবেগের বশে নিজেদের প্রতি খেয়াল নিচ্ছি না। চলেন সবাই আমরা নিজেদের যত্ন নিই। এভাবে আর জ্বলজ্বলে তারাদের খসে পড়তে দিতে চাই না।’
সারা দিন সুস্থ ছিলেন খালিদ। ইফতারির আগে আগে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। ওই ফ্ল্যাটে সাত বছর ধরে দারোয়ান হিসেবে আছেন মো. শাজাহান। শাজাহানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল খালিদের। খালিদের টুকটাক কাজ করে সহযোগিতা করতেন তিনি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত খালিদের সঙ্গেই ছিলেন শাজাহান।

অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শাজাহান। এ দিনের ঘটনা সম্পর্কে শাজাহানের বর্ণনায় জানা যায়, সুস্থ মানুষ। দুপুরের পরপর মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। চারটার পর বাসায় ফেরেন। ইফতারির আগে অসুস্থ বোধ করেন তিনি। শাজাহান বললেন, ‘আমি ওষুধ নিয়ে এসে খাইয়ে দিলাম। বুক ব্যথা করছিল, বুকে মালিশ করে দিলাম। একটু ভালো লাগার কথা বললেন। এরপর আমি ইফতারির জন্য চলে আসি। ইফতারি করে আবার গিয়ে দেখি ভালো, গান শুনছিলেন। আমি কিছুক্ষণ থেকে চলে আসি। ঠিক সাতটার দিকে আবার গেলাম। গিয়ে দেখি শুয়ে আছেন। অবস্থা দেখে মনে হলো খারাপ। কথা বলতে পারছিলেন না। আগেই তাঁর দুটি রিং পরানো ছিল। আমি তাড়াতাড়ি নিচ থেকে একজন লোক ডেকে নিয়ে আসি। ধরে বাসা থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিই। আমার কাছে মনে হয়েছে, নিচে নামানোর পরপরই মারা গেছেন তিনি।’

খালিদ সাইফুল্লাহ (১ আগস্ট ১৯৬৫—১৮ মার্চ ২০২৪)

Also Read: ‘নওরীন নাতিখাতি’র স্মৃতিতে খালিদ মামা

মৃত্যুর আগমুহূর্তে খালিদের বাসায় উপস্থিত ছিলেন সংগীতশিল্পী রোম্মান আবদুল্লাহও। তাঁকে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দিয়ে চাইম ব্যান্ডটি আবার নতুন করে গঠনের কথাবার্তাও চলছিল। এ কারণে প্রতিদিনই খালিদের বাসায় যাওয়া আসা ছিল তাঁর। আগামী ১৩ এপ্রিল শো ছিল খালিদের। শোর বিষয় নিয়ে ইফতারির পরপর রোম্মান তাঁর বাসায় যান।

এ দিন বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রোম্মান বললেন, ‘শোর ব্যাপারে খালিদ ভাইয়ের কাছে আসছিলাম। এসে নিচ থেকে ফোন দিলাম, রিং হলো, ধরল না কেউ। বাসা দোতলায় নিচ থেকে দরজা দেখা যায়। দেখলাম দরজা খোলা। ওপরে গিয়ে দেখি দারোয়ান তাঁর বুকে পাম্প করছেন। অবস্থা খারাপ। আমি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ প্রস্তুতির জন্য দ্রুত বাসা থেকে নেমে যাই। কিছুক্ষণ পরে হাসপাতালে আনা হলো। ততক্ষণে সব শেষ।’

খালিদ সাইফুল্লাহ

এদিন জানাজার আগে আগে উপস্থিত সহকর্মীদের অনেকেই তাঁর গান, তাঁর কথা নিয়ে স্মৃতিচারণা করছিলেন। খালিদের সঙ্গে গান করার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সংগীতশিল্পী পলাশ বলছিলেন, ‘খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সাত-আটটা অ্যালবামে কাজ করা হয়েছে। এমন একজন শিল্পী ছিলেন তিনি, স্টুডিওতে ঢুকে ধুমধাম গেয়ে ফেলতেন। এসে মাইক্রোফোনে দাঁড়িয়ে এক-দুবার মিউজিক শুনতেন, এরপর বলতেন, চল, হয়ে যাবে। সত্যিই বড়জোর দুবার গাইতেন। গান হয়ে যেত। খালিদ ভাইকে আমার গড গিফ্টেড শিল্পী মনে হতো।’  

Also Read: ফেরানো গেল না খালিদকে

তখনো জানাজার সময় হয়নি। সহকর্মীদের কেউ কেউ বলছিলেন খালিদকে শহীদ মিনারে নিতে। কিন্তু খালিদের পরিবার থেকে বাধা। বোনের জামাই আশরাফ আহমেদ বলছিলেন, ‘না, আমরা শহীদ মিনারে নেব না। শহীদ মিনারে নিয়ে কী হবে? এই যে এত মানুষ এখানে এসেছেন, এত ভালোবাসা, এটাই তাঁর আত্মাকে শান্তি দেবে।’
জানাজা শেষ হলো। রাত তখন ১১টা পেরিয়েছে। আর দেরি করল না। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলল গোপালগঞ্জের পথে। যেখানে তাঁর জন্ম হয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্সের হিমশীতল ঘরে শুয়ে মহাকালে যাত্রায় সেই কৈশোরের স্মৃতির শহরে ছুটে চললেন প্রিয় শিল্পী। কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাঁকে, কোনো বাঁধনেই বাঁধা গেল না তাঁকে।

Also Read: ‘সরলতার প্রতিমা’ গায়ক খালিদ মারা গেছেন