Thank you for trying Sticky AMP!!

তুলসী চক্রবর্তী

তুলসী চক্রবর্তী: ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা

‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, কিংবা ‘একটি রাত’ দুই বাংলায় খুব চেনা সিনেমা । সেসব ছবিতে তিনি কখনো মেসমালিক, কোথাও হোটেলমালিক, কোথাও সরাইখানার মালিক। নায়ক কিংবা খলনায়ক নন, তথাকথিত ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেও সব সিনেমায় স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন তিনি।
সাদা-কালো যুগের প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর কথা বলছি। মূলত কৌতুকের চরিত্রের শিল্পী ছিলেন, কিন্তু আজও তিনি যেকোনো উঠতি অভিনেতা-অভিনেত্রীর অনুপ্রেরণা! গত রোববার ৩ মার্চ, তুলসী চক্রবর্তীর জন্মদিন।

দেখতে কখনো তথাকথিত নায়কের মতো নন। সুদর্শনও বলা যাবে না। বড় বড় চোখ, এক মাথা টাক, অবিন্যস্ত দাঁত আর মোটা ভুঁড়ির ছোট চরিত্রের বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়প্রতিভাকে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশ পাথর’ বানাতে পারতেন না, এটা তিনি তাঁর শেষজীবনে বলে গেছেন।

সাড়ে চুয়াত্তরে তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবী। ছবি: সংগৃহীত

এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীর নাম বলতে গিয়ে বলেছেন ‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না, কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন, নির্ঘাত অস্কার পেতেন।’

গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকের বাংলা চলচ্চিত্র যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে তুলসী চক্রবর্তী অপরিচিত নন। এই নাম শুনলে অনেকেরই চোখে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’, অন্যটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’।

পথের পাঁচালীর একটি দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত

১৯৫৩ সালের কথা, মুক্তি পেল নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল, ছবিটির মাধ্যমে এক নতুন জুটি এসেছে পর্দায়। সে সময় একটু বয়সী দর্শক মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাঁদের দাবি, নায়ক-নায়িকা তো তুলসী-মলিনা, উত্তম-সুচিত্রা তো আসলে পার্শ্বচরিত্র! শোনা যায়, সে সময় টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলেছিল ছবিটি। এখনো দেখা যায়, কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখা শেষে বের হতে হতে কোনো তরুণ বলে উঠছেন, ‘কই, কোথায় গেলে গো?’ যুগে যুগে এ সংলাপ ফিরেছে সিনেমারসিকদের মুখে মুখে।
অভিনয়জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’ ছবিতে অভিনয় করে। শোনা যায়, সে ছবির শুটিংয়ের আগে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পোশাক ডিজাইনার তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছেন শুনে আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি!’ শুধু অভিনয়ের জন্য নয়, ‘পরশ পাথর’ তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলফলক এ ছবি নিয়ে নানা গল্পের কারণে।

এ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী চক্রবর্তী নিয়েছিলেন মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা। সত্যজিৎ রায় সম্মানী বাড়ানোর কথা বললে তুলসী চক্রবর্তী বলেন, ‘এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল! তারপর আর হয়তো কোনো ছবিতেই সুযোগ পাব না।’

ইন্দ্রাণী ছবির সেটে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত

জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩ মার্চ হাওড়ায়। বাবার অকালমৃত্যুতে মা নিস্তারিণী দেবী কলকাতায় চলে এলেন সদ্য তরুণ তুলসীকে নিয়ে। জোড়াসাঁকোয় থাকতেন বড় চাচা প্রসাদ চক্রবর্তী। চাচা কাজ করতেন স্টার থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতের দলে। চাচার সঙ্গে থিয়েটারে প্রথম যাতায়াত। এরপর আস্তে আস্তে থিয়েটারের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা। ১৯১৬ সালের কোনো একদিন স্টার থিয়েটারের অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে এলেন তুলসী। স্টারে কাজ করা শুরু করলেন ট্রেইনি আর্টিস্ট হিসেবে। অভিনয়ের পাশাপাশি সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন গানে, তবলায়, পাখোয়াজে। ১৯২০ সালে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকের মাধ্যমে স্টেজজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯২৭ সালে মনমোহন থিয়েটারে যুক্ত হন, তারপর মিনার্ভা, রংমহল থিয়েটারে কাজ করে প্রায় ৪২টি প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন।

তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য কলকাতায় শুরুতে টানাপোড়েনে কেটে গেছে তুলসী চক্রবর্তীর জীবন। প্রথমে উত্তর কলকাতার একটি দোকানে বাসনপত্র ধোয়ার কাজ করেন, তারপর সার্কাসে জোকার হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছিলেন।

থিয়েটারে কাজ করতে করতে বাংলা সিনেমার জগতে প্রবেশ করলেন ১৯৩২ সালে ‘পুনর্জন্ম’ ছবির মাধ্যমে। এরপর একে একে ‘শচীদুলাল’, ‘মনোময়ী গার্লস স্কুল’, ‘শঙ্খ সিন্দুর’, ‘কবি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পরশ পাথর’, ‘মৃতের মর্ত্যে আগমন’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ইত্যাদি ছবিতে।

কলকাতার শুটিংপাড়ায় সুচিত্রা সেন, উত্তম কুমার, পাহাড়ি সান্যাল, বিকাশ রায়, অমর মল্লিক, কমল মিত্র, দীপক মুখোপাধ্যায়, বনানী চৌধুরী ও অন্যান্যের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত

উত্তমকুমার ও ছবি বিশ্বাস যা বলেছিলেন

ছবি বিশ্বাসকে অনেকেই চেনেন হয়তো। সেই ছবি বিশ্বাস, যিনি কিনা কোনো দিনও শুটিং করার সময় সংলাপ মুখস্থ করতেন না। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং তারপরই রীতিমতো অভিনয়ের দাপট! কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সেদিন তাঁকে কোমর বেঁধে নামতে হতো।

ছবি বিশ্বাস বলতেন, ‘কী জানি কী প্যাঁচ তুলসী কষবে!’ ছবি বিশ্বাস খুব ভালো করে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে চ্যালেঞ্জ রেখে, টক্কর দেওয়ার মতো।
তুলসী চক্রবর্তীর বিষয়ে বলতে গিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার বলতেন, ‘তুলসীদার মতো অভিনয় তো কোনো দিনই করতে পারব না, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। ওনাকে প্রণাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে; পরিচালক-প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই, তুলসীদাকে ডেকে নিই। উনি থাকলে সিনটা দারুণভাবে উঠে যায়। ওনার ঋণ তো কোনো দিন শোধ করতে পারব না, যেভাবে যেটুকু পারি সাহায্য করি।’

নিমাই–এর একটি নাটকীয় দৃশ্যে শিশুশিল্পীদের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত

আর নিজের সম্পর্কে তুলসী চক্রবর্তী বলতেন, ‘আমি হলাম রান্নাঘরের হলুদ, যেখানে-সেখানে কাজে লেগে যাই।’ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চোখকান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেড়াই। চরিত্রমতো যখন যাকে দরকার, তাকে তুলে ধরি। এসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দরকার হয় নাকি? এসব তোমার-আমার চারপাশে ঘুরছে। যেকোনো একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’
সারাটা জীবন সংগ্রামে কেটেছে

তুলসী চক্রবর্তী কমেডিয়ান না পূর্ণ অভিনেতা, সে প্রশ্ন দূরে থাক। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা, সে কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি ও উর্দুতেও কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে বহু ছবির জন্য পারিশ্রমিকও নেননি শুধু ভালোবাসার জন্য। চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসব ভাবতেন না তুলসী চক্রবর্তী। মনপ্রাণ ঢেলে অভিনয় করতেন।

হাওড়ার বাড়িতে তাঁর স্ত্রী উষারাণী দেবী। ছবি: সংগৃহীত

সারা জীবনে ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টির মতো হিন্দি সিনেমা করলেও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবু নিজের বাড়িও দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। ছোট্ট দুই কামরার বাড়িতে থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। উত্তমকুমার, তরুণকুমারদের ছেলে বলে ডাকতেন নিঃসন্তান তুলসী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিম বাংলার সরকারের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনো বন্দোবস্ত ছিল না তখন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষা রানী দেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সব কটি মেডেলও নাকি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অভিনয়জীবন ভালো কাটলেও যাপিত জীবন কষ্টে কেটেছে তুলসী চক্রবর্তীর। দুই বাংলার দর্শকের অন্তরে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন তিনি, এটাই মরণোত্তর জীবনের বড় পাওয়া হিসেবে থাকবে যুগের পর যুগ।

পরশপাথর ছবির একটি দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত