Thank you for trying Sticky AMP!!

ঈদ জোয়ারের টান

আফজাল হোসেন

ঈদ এলে এখন আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। একসময় সেখানে আব্বা, আম্মা আর আমাদের দুই ভাইয়ের একমাত্র বোনটা থাকত।
আমি পরিবারের বড় ছেলে। আমার ছোটটি চার বছরের ছোট। তার নাম আলফাজ হোসেন। সবাই ডাকি বাবুল বলে। একমাত্র বোনটা আমার চেয়ে ২০ বছরের ছোট। নাম রুমানা আফরোজ। ডাকনাম রুমা, আমি ডাকি মনা।
আমরা দুই ভাই ঢাকায় থাকতাম। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া হবে, তার কত রকম প্রস্তুতি ছিল। আব্বা-আম্মার জন্য কাপড় কিনতাম। বোনের জন্য অনেক কাপড়চোপড় কিনেও মনে হতো কম হয়ে গেল। ওর সাজগোজের জিনিসপত্র, ফিতা, চুড়ি, স্যান্ডেল, হাতব্যাগ, যা মনে আসত কিনতাম। সেসব কেনাকাটায় অদ্ভুত আনন্দবোধ হতো।
বাড়ির পথে দীর্ঘযাত্রায় মনে হতো সারা দিন আম্মা অস্থির থাকবেন। সন্ধ্যায় বাড়ির পেছন দিকের বাগানে বারবার আসবেন-যাবেন। কখনো কখনো দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকবেন, আমরা কখন আসছি। হয়তো দূরে গাড়ির হর্ন বাজলে আম্মার বুকের মধ্যে খুশি লাফিয়ে উঠত। আমরা এসে গেছি—এমন ভাবনায় পাখির মতো খুশি উড়াল দিয়ে উঠত আম্মার মনে।
আব্বা ছিলেন খুব চাপা স্বভাবের। কাউকে বুঝতে দিতে চাইতেন না ছেলেদের অপেক্ষায় তাঁরও বুকের ভেতর বাড়তি ঢিপঢিপ হচ্ছে। খুব জরুরি কাজের অজুহাতে বাস স্টপেজের দিকে ব্যস্ত থাকতেন। গাড়ি থেকে কারা কখন নামছে, খেয়াল রাখতেন। তবে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতেন না।
ছেলেদের নামতে দেখলে উল্টো হেঁটে মিষ্টির দোকানে যেতেন। রসগোল্লা, সন্দেশ অথবা জিলাপি, যেটা গরম পাওয়া যায়, কিনে হাতে বয়ে বাসায় আসতেন।
আমরা কেমন আছি, সেটা বোধ হয় দেখে বুঝে নিতেন। একটা প্রশ্নই করতেন, পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো? উত্তরের অপেক্ষা যে করতেন, তা নয়। আম্মাকে বলতেন, মিষ্টি খেতে দাও, গরম-গরম ভালো লাগবে। আম্মা একটু রাগ দেখিয়ে বলতেন, এখনই মিষ্টি খেতে হবে, হাতমুখ ধুয়ে নিক তারপর।
সে সময়ে গ্রামে বিদ্যুৎ যায়নি। আম্মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। গায়ে-মাথায় হাত বোলাতেন। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিতেন আর বলতেন, শুকিয়ে গেছিস। খুব কি খাওয়ায় কষ্ট হয়?
ছোট বোন মনা খুবই লাজুক। ভাইয়েরা ঢাকায় থাকে, দূরত্ব তৈরি হয়েই আছে। বছরে বার দুই-তিন যাই আমরা। দূরত্ব ঘুচে যেতে সময় লাগে। খানিকটা নিকটের হতেই আবার চলে যাওয়ার সময় এসে যায়।
ঈদে আমার সবচেয়ে আনন্দ উপভোগের বিষয় ছিল ক্যামেরায় ছোট বোনের ছবি তোলা। ঢাকা থেকে আনা কাপড়চোপড় পরিয়ে সাজগোজের জিনিসপত্র দিয়ে সাজিয়ে এভাবে দাঁড়াও, ওইভাবে বসো—এসব বলে ছবি তুলতাম আর রুমা বা মনা থাকত খুবই অস্বস্তিতে।
ছাত্রজীবন থেকে উপার্জন করতাম, তাই আব্বা-আম্মার জন্য কাপড়চোপড়, ঘড়ি, জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি কিনে নিয়ে আনন্দ পাওয়ার সুযোগ ছিল।
আম্মার খুশি হওয়াটা ছিল পৃথিবীর অন্য মায়েদের মতোই। আব্বার খুশি হওয়া অন্য রকম উপভোগ্য ছিল। আব্বা খুশি হতেন কি না, তা চেহারা দেখে কিছুই টের পাওয়া যেত না। আব্বাকে যাঁরা চিনতেন, সবারই জানা, কাপড় নিয়ে তাঁর শৌখিনতা ছিল। দুই বেলায় একই কাপড় পরে থাকা পছন্দ করতেন না। সাদা পায়জামা, ঘি রঙের পাঞ্জাবি অথবা কলারওয়ালা লম্বা শার্ট ছিল প্রিয় পোশাক। কাপড়ের ভাঁজ ভেঙে গেলে তা পাল্টে নতুন আরেক সেট কাপড় পরে নিতেন।
ব্যতিক্রম ছিল ঈদের পরে যখন আমার কেনা কাপড় পরতেন। দুই বেলা একই কাপড় পরে থাকতে শুধু সেই সময়েই দেখা যেত।
আব্বা এখন নেই। যখন ছিলেন, সেই মানুষটার কিছু কিছু অসাধারণত্ব আমাকে এখনো অবাক করে। ঈদে কাপড়, ঘড়ি বা স্যান্ডেল যা কিনে নিয়ে যেতাম, খুশি যে হয়েছেন, তা প্রকাশ করতেন না। তবে যেদিন বাড়ি থেকে ঢাকায় ফিরব, বেরোনোর সময় টাকা গুঁজে দিতেন পকেটে। ছেলের জন্য হাতখরচের টাকার একটা পরিমাণ তো ছিলই, তারও চেয়ে যা বেশি অংশ পাওয়া যেত, বুঝে নিতে অসুবিধা হতো না, যা যা তাঁর জন্য কিনে আনা হয়েছে, সেসবের আনুমানিক মূল্য।
আব্বার সামনে আপত্তি জানানোর সাহস ছিল না। আম্মার মাধ্যমে আপত্তি জানিয়েও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে স্বভাব বদলানো যায়নি। আম্মার কাছে বলেছেন, ছেলে এই বাড়তি খরচটুকু করেছে, এতে তার বাড়তি কষ্টও করতে হয়েছে। বাবা হিসেবে সেটা ভাবলে আমার কষ্ট হয়।
ঈদে বাড়ি যাওয়ার আনন্দ ছিল। তবে বাড়ি যাওয়া ছাত্রকালে অতটা আরামের ছিল না। বিআরটিসির একটা বাস যেত ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায়। টিকিট পাওয়া ছিল আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো। মতিঝিল, কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টো দিকে ছিল বাস ডিপো। টিকিট সেখানে বিক্রি হতো। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর ঢিপঢিপ করে বুক কাঁপতেই থাকত, টিকিট পাব তো। টিকিট পাব তো।
টিকিট কাউন্টারের সামনে পৌঁছে হয়তো জানতে পারলাম মাত্র একটা সিট আছে, পেছনের চাকার ওপর। অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে, মুখমণ্ডলে বড় হাসি ছড়িয়ে দ্রুত বলতাম, দিন।
সকালে উঠলে রাত আটটার দিকে সাতক্ষীরা পৌঁছানোর কথা। এত লম্বা ভ্রমণের জন্য চাকার ওপরের সিটটা কষ্টকর জেনেও সেই টিকিট কিনে মনে ধেই ধেই নৃত্য বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। ভাবলে এখন অবাক লাগে।
হাসির কথাও বলি। বাসের টিকিট কিনতে গিয়ে কখনো শুনেছি, টিকিট আছে তিনটে। জানালার পাশে, তার পাশেরটা এ দুটো হবে মাঝামাঝি জায়গাতে আর সামনের দিকে যদি চাই, এক লাইন পেছনে জানালার পাশেরটা হবে।
এ রকম পছন্দ করার সুযোগ পেলে সহজে বলতে পারিনি অমুক সিটটা দিন। কোনটা হলে ভালো হয়, সে হিসাব-নিকাশ অস্থির হয়ে যেতাম। কোনটা ভালো হবে, জানালার পাশেরটা, নাকি তার পাশেরটা। সামনের দিকের সিটটা নয় কেন, তা নিয়েও ভাবাভাবি চলত।
মানুষের স্বভাব বোধ হয় এ রকমই। পছন্দের সুযোগ না থাকলে যা পাওয়া যায়, তাতেই সন্তুষ্টি, আর সুযোগ পেলে মাথায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধার হিসাব-নিকাশ।
ঈদের ছুটি বা ঈদের নানান রকম আনন্দের বিষয় ভাবতে বসলে খইয়ের মতো ফুটতে থাকে স্মৃতি। মনে হয় অনেক কিছু বদলে গেছে। আবার অনেক কিছু একটুও বদলায়নি।
এখন আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। আব্বা নেই। আম্মাকে টেনে এনেছি শহরে। বাড়িটা শূন্য পড়ে থাকে। ঈদের দিন ওই বাড়িতে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা আসে, মানুষবিহীন বলে ঈদের আনন্দ সে বাড়িতে ঢোকে না।
ঈদের কথা ভাবলে একটা ছবি ভেসে ওঠে মনে। নতুন কাপড় পরে আব্বা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে ঈদগাহে যাচ্ছেন। ঈদের দিন এইকালে সেই একই চিত্র ঢাকাতেও দেখতে পাই। আমার দুই সন্তানকে নিয়ে যখন নামাজের জন্য বের হই, মনে হয় আমি আমি নই, আমার আব্বা। সঙ্গে যে দুই ছেলে, তারা আরাফ বা ঈমান নয়, আমরা দুই ভাই আফজাল আর আলফাজ।
ঈদের নামাজ শেষ হলে মোনাজাতের আগে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ বা অর্থ বর্ণনা করার সময় ঈদগাহ সংস্কার অথবা ইমাম সাহেবের সম্মানীর জন্য টাকা তোলা হতো। সাদা চাদর বা গামছার চার কোনা টেনে ধরে দুজন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে আসতেন সামনে। আব্বা আমাদের হাতে টাকা দিতেন। আমরা দুই ভাই সেই টাকা সংগৃহীত টাকার মধ্যে ফেলে খুবই খুশি হতাম।
সেই ছবি বদলায়নি। বদলে গেছে সময়, মানুষ তিনজন। এখন ঢাকায় প্রায় একই রকম দৃশ্যে ছেলে দুটোর হাতে যখন টাকা দিই, তারা আনন্দ ও উৎসাহে মসজিদের দানবাক্সে তা গুঁজে দেয়।
প্রতি ঈদে এমন সময়টায় আমার গা শিরশির করে। একই প্রশ্ন প্রতিবার মনে জেগে ওঠে, আমি কি সত্যিই আমি, নাকি আমি আমার বাবা, মরহুম ডাক্তার আলী আশরাফ হোসেন!
সন্তানদের দিকে তাকাই, আমাদের ছোটবেলাকে পেয়ে যাই। আবার নিজের দুই সন্তানের মুখ দেখে ফিরে পাই নিজেকেও।