Thank you for trying Sticky AMP!!

চাঁদ থেকে ঈদরাত!

বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের জনপ্রিয় নাটক ছিল ‘জব্বর আলী’। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় কথাটা চানরাত। পুরান ঢাকায় চানরাইত, মানে ঈদের আগের রাত। আগে চাঁদবিকেলটা বিশেষ বিকেল ছিল। টেনশনের বিকেল। সুখের টেনশন। সন্ধ্যায় ইফতার শেষে সবার টেনশন, কখন টিভিতে চাঁদ দেখার ঘোষণা আসবে। মায়েদের ছোটাছুটি থাকত কিচেনে, কান থাকত টিভিতে। চাঁদ দেখার জন্য ‘চাঁদ দেখা কমিটি’ ছিল। কমিটি বললেই ঈদ হবে। এমনও হয়েছে, সবার টেনশন দূর করে রাত ৯টায় খবর এসেছে, অমুক জেলায় চাঁদ দেখা গেছে, কাল ঈদ। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুদিন আগেই আমরা জেনে যাই ঈদ কবে। সামনে আর চাঁদ দেখা কমিটির দরকার হবে বলে মনে হয় না।

সব চাঁদরাতের সন্ধ্যায়ই বিনোদন শুরু হয় মনকাড়া এক কমন গান দিয়ে। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এ রকম ১০০% ভোট পাওয়া গান সহজে শোনা যায় না। সবার পছন্দ। সব চ্যানেলে একই গান, গায়ক-গায়িকা ভিন্ন। যখন ছোট ছিলাম, এত চ্যানেল ছিল না। ছিল শুধু বিটিভি। এখনকার মতো ৭-৮ দিন ধরে ঈদ অনুষ্ঠানও হতো না। শুধু ঈদের দিন ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান হতো। বিশেষ অনুষ্ঠান বলতে ঈদের নাটক, বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও পুরোনো কোন মজার বাংলা মুভি। ঈদের নাটকে বছরের পর বছর জায়গা দখল করে নিয়েছিল আমজাদ হোসেনের ‘জব্বর আলী’। বছরে ১টা এপিসোড। রোজার ঈদে। সারা বছর আমরা সেই এপিসোডের জন্য বসে থাকতাম। নিউ জেনারেশন আশ্চর্য হলেও কিছু করার নাই, আমরা আগের ঈদে জব্বর আলীর কী ঘটেছিল, সেটা এই ঈদে মনে রাখতাম। প্রত্যেক পর্বের আলাদা নাম ছিল। একটা পর্ব খুব জনপ্রিয় হয়েছিল—‘এত দিন কোথায় ছিলেন’। সেই ঈদের নাটকে জব্বর আলী এয়ারপোর্টে নেমে অ্যারাবিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বলেছিলেন, ‘এত দিন দুবাই ছিলাম।’

ঈদের রাতে টিভিতে এই অনুষ্ঠানগুলো দেখা ছিল মিস না করার বিনোদন। দিনে বিভিন্ন আত্মীয়-বন্ধুদের বাসায় বেড়ানোর পর রাতে প্রস্তুতি ঈদের নাটক দেখার। আমরা আত্মীয় বা বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করে একটা বাসায় পরিবারের সবাই বসে মজা করে নাটক দেখতাম। নাটক আগে হতো। নাটক শেষে ডিনার বিরতি। বিরতির পর ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’। তখন এই ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-জার্মানির মতো অবস্থান দখল করে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মরহুম মেয়র আনিসুল হক আর ফজলে লোহানি। যদিও ফজলে লোহানিকে ঈদের কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অভিনেতা আফজাল হোসেনও দু-একটা ঈদ ম্যাগাজিন উপস্থাপনা করেছিলেন। টিভি অনুষ্ঠান ছিল ঈদ আনন্দের বড় বিষয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ বা ‘তেরো নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’ ছবি দেখার জন্য মুখিয়ে বসে থাকতাম। ছবি হতো দিনের বেলায়। আফটার লাঞ্চ। আশপাশের অল্প আয়ের মহিলা-বাচ্চারা চলে আসত টিভিতে বাংলা ছবি দেখতে। ড্রয়িং রুম হয়ে উঠত মিনি সিনেমা হল।

সিনেমা মুক্তি পেত সিনেমা হলেও। ঈদে ছবি মুক্তি দেওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো প্রযোজকদের মধ্যে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য ঈদ সিনেমা ছিল প্রধান বিনোদনের বিষয়। অ্যাডভান্স টিকিট কেটে ঈদে ছবি দেখতেন তাঁরা। ঈদের দিন ম্যাটিনি বা ইভিনিং শোতে দর্শক গিজগিজ করত। নতুন রং-বেরঙের পোশাকে দর্শকদের হইহল্লা আর টিকিট ব্ল্যাকারদের ‘অই ডিসি ডিসি, রিয়াল রিয়াল’ শব্দে গমগম করত সিনেমা হলের আঙিনা। মেইন গেটে লাল বোর্ডে সাদা হরফে ঝুলত, প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ।

আমার মামাতো ভাই ঈদে বেড়াতে এসেছেন। আগের দিন বলে রেখেছেন ঈদের দিন ছবি দেখাতে নিয়ে যাবেন। শ্যামলী হলে নিয়ে গেলেন স্কুলবয় আমাকে। ছবির নাম ‘দাতা হাতেম তাই’। ১০ টাকার টিকিট ব্ল্যাকে ৫০ টাকায় কিনে আমাকে ছবি দেখালেন। মজা পেলাম ভীষণ। বাসায় এসে রাতে টিভির ‘আনন্দমেলা’র পর কলেজপড়ুয়া কাজিনদের নিজেই অভিনয় করে করে ‘দাতা হাতেম তাই’-এর গল্প বললাম। তারা ‘আনন্দমেলা’র পর আরেক নতুন লাইভ অনুষ্ঠান উপভোগ করলো।

প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আসার পর এই শতকের গোড়ার দিকে ঈদ বিনোদনের প্যাটার্ন পাল্টাতে থাকে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ঈদের নাটক ও অনুষ্ঠানে জোর দেওয়া হয়। ভালো বাজেটে ভালো ঈদের নাটক বানানো হতে থাকে। ঈদ অনুষ্ঠানগুলোয় নতুন সংযোজন ও নতুনত্ব আনায় মনোযোগ দেয় টিভি চ্যানেলগুলো। আমি নিজেই নাট্যকার ও নির্মাতা হিসেবে অনেক ঈদ নাটক করেছি, প্রশংসাও পেয়েছি। ঢোল পিটালাম না, তিন সত্যি। টক শোগুলোতেও এল নতুন মাত্রা। ‘তৃতীয় মাত্রা’য় জিল্লুর রহমান যোগ করলেন রাজনীতিবিদদের পরিবার নিয়ে টক শো ও বিভিন্ন গান-অভিনয়। বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। প্রথম প্রথম মজা পেয়েছে দর্শক।

এখন টিভি চ্যানেল অনেক। নাটক-অনুষ্ঠানও হয় অনেক। অনেকের মতে সংখ্যা বেড়েছে, মান কমেছে। নতুন অনেক উপস্থাপক-উপস্থাপিকা এলেও একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আনিসুল হক বা ফজলে লোহানি আসেনি। ঈদ বিনোদনেও পড়ছে এর নেগেটিভ প্রভাব। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য মিডিয়ার হাতের মুঠোয় আসাকে দায়ী করছেন। কিন্তু দুর্জনেরা তা মানতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, তা-ই যদি হতো, তাহলে এক মাস ধরে মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল হইহল্লা করে টিভিতে দেখত না, মুঠোফোনেই দেখত। দুর্জনদের কথা আমাকেও চিন্তার খোরাক দিয়েছে।

সবকিছুরই ‘স্যাচুরেশন’ আছে। এটা রাসায়নিক শব্দ। ‘স্যাচুরেশন’ মানে আপনি গ্লাসের পানিতে লবণ মেশাতে মেশাতে এক সময় দেখবেন লবণ আর গলছে না। সেটাই স্যাচুরেশন। লবণ গলাতে হলে আপনাকে আবার পানি ঢালতে হবে। অথবা অন্য কিছু। পাকা কেমিস্টরাই পারবেন ঘোলা পানিকে স্যাচুরেশনমুক্ত করতে।

কিন্তু একটা জিনিসের ‘স্যাচুরেশন’ হবে না। চাঁদরাতের সেই গান, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। একটা হিসাব দিই। এই গানটা আপনি বছরে মাত্র একবারই শোনেন। ধরা যাক ৭৫ বছরের এক ভদ্রলোক। তিনি ৫ বছর বয়স থেকে গান বোঝেন। তাহলে তিনি জীবনে মাত্র ৭০ বার এই গানটি শুনেছেন। এবার আপনার হিসাবে চলে যান। আপনার যা বয়স, তার থেকে ৫ মাইনাস করেন। যে সংখ্যা দাঁড়াবে, জীবনে আপনি ঠিক ততবার এই গানটা শুনেছেন। কিন্তু গানটি পচেনি। আপনার মনে হচ্ছে, এই গান আপনি শত শতবার শুনেছেন, শুনছেন। একেই বলে অমর সৃষ্টি।

আপনি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা যে দলের সমর্থক হন, রমজানের ওই রোজার শেষে আপনাকে ঈদের শুভেচ্ছা। হেরে গেলেও একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে গালাগালি করবেন না, কোলাকুলি করবেন।

ঈদ মোবারক!