Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রথম ঈদের নাটক

আমজাদ হোসেন
>কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী এবং লেখক আমজাদ হোসেন আর নেই। আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তিনি মারা যান। আমজাদ হোসেন তাঁর ঈদের নাটক নিয়ে প্রথম আলোতে লিখেছিলেন ২০১১ সালের ৬ নভেম্বর। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পাঠকদের জন্য আবার দেওয়া হলো।

একটি নাটক, সারা দেশের ছোট-বড় সব মানুষের মনজুড়ে জায়গা করে নিতে পারে। বছরের পর বছর জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকে। আমার এই দীর্ঘ জীবনে আমি তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। জনমনে আমার সৃষ্টির এই আনন্দ-উন্মাদনা দেখে বিস্ময়ে আমিই স্তব্ধ, হতবাক হয়ে থাকি।

বছরের পর বছর শুধু ঈদে এ নাটকটি দেখার জন্য সারা দেশের দর্শক যেভাবে অপেক্ষায় থাকে—হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে। দিনের পর দিন টেলিফোনে যেভাবে জিজ্ঞাসা করে, নাটকটি এবার ঈদে হচ্ছে কি না? হলে এবারের গল্প কী, দেশের কোন দুর্নীতি নিয়ে লিখছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর যেভাবে জানতে চায়, আমি তাদের কথাগুলো যদি প্রতিদিনের ডায়েরিতে টুকে রাখতাম, তাহলে বোধ হয় কম করে হলেও দুই হাজার পৃষ্ঠার একটি বই বের করতে পারতাম এত দিনে।

এবার এই নাটকটির শুভ জন্মদিনের কথা বলি। ১৯৭৪ সাল। বিটিভি কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেছে, ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে এবার থেকে নাটকও থাকবে। বিটিভির জন্ম ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। তার মানে এর আগে কোনো ঈদের অনুষ্ঠানে নাটক হয়নি। এই ১৯৭৪ সালেই প্রথম হবে। বিটিভির উদ্বোধনীতে মুনীর চৌধুরীর একতলা দোতলা নাটক দেখানো হয়েছে। তারপর থেকেই আমি টেলিভিশনে নাটক লিখি। অভিনয় করি। বিটিভির নাটকে আমার সুনাম ছিল বলেই ঈদে এই প্রথম নাটক লেখার জন্য প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে খবর

দিলেন। আমি গেলাম। মুস্তাফিজের মুখ থেকেই প্রথম শুনলাম, এবার থেকে ঈদের অনুষ্ঠানে নাটক হবে এবং সেই নাটক আমাকেই লিখতে হবে। আমি তো হতবাক। আর মনে মনে ভাবছি, ধর্মীয় উৎসবে নাটক লিখব কী নিয়ে? ওর এই প্রস্তাবে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি ভীষণ দুর্ভাবনার মধ্যে পড়েছি, ঈদের উৎসবে কী নাটক লিখব! এক মাস রোজার পর যে ঈদ। সেই ঈদের কোনো ঘটনাই খুঁজে পাচ্ছি না মনে মনে। আমাকে দুই দিনের সময় দেওয়া হলো। একদম নাটক লিখে তার কাছে যেতে হবে। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। কোনো প্লট খুঁজে পাচ্ছি না। কলম হাতে নিলেই হাতটা কেঁপে উঠছে।

দুই দিন পর মুস্তাফিজুর রহমানের কাছে গেলাম ঠিকই, কিন্তু খালি হাতে। আমার হাতে কোনো স্ক্রিপ্ট নেই। একটু নিচু স্বরে আমতা আমতাভাবে বললাম,

পারব না।

‘কী পারবা না?’

আমি এই ঈদের নাটক লিখতে পারব না।

মুস্তাফিজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘লিখতে তোমাকে হবেই।’

এই বলে চুপ হয়ে রইল মুস্তাফিজ। দুজনেই রোজা আছি। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই। তখন দুপুরবেলা। দিনের অর্ধেক চলে গেছে। মুস্তাফিজের এই গুরুগম্ভীর ভাব দেখে আমি একটু আনমনা। মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছি। হঠাৎ দরজা লক করার শব্দ শুনে আমি চমকে উঠি। সামনে তাকিয়ে দেখি, চেয়ারে মুস্তাফিজ নেই। দরজার কাছে গিয়ে বুঝলাম, মুস্তাফিজ রুম লক করে চলে গেছে। আমার মাথা উত্তপ্ত হয়ে গেল। বদ্ধ রুমে ভয়-ভয় শূন্য-শূন্য লাগছে। ও অবশ্য জানে, আমার কাছ থেকে কীভাবে লেখা আদায় করতে হবে। আমিও বুঝতে পারলাম এখান থেকে আমার মুক্তি নেই। আমাকে লিখতেই হবে। কিছুক্ষণ পর আমি নাটকটি লিখতে শুরু করলাম। সারা পৃথিবীর কথা ভুলে গিয়ে আমি যখন লেখার গভীরে ডুবে আছি, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম, মুস্তাফিজ রুমে ঢুকছে। আর তার সঙ্গে পিয়নের নানা রকম ইফতারি, শরবত ইত্যাদি। মুস্তাফিজ চেয়ারে বসতে বসতেই বলল,

‘কলম রাখো। এখন ইফতারের সময়। আগে ইফতার করে নাও।’

আমি যে রোজা রেখেছি, এতক্ষণ এ কথা মনেই ছিল না। অজু করার জন্য তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম।

ঈদের দিন রাত সাড়ে আটটায় বিটিভিতে প্রথম এই নাটক দেখে হইচই পড়ে গেল সারা দেশে। টেলিফোনের পর টেলিফোনে প্রশংসা। পরের দিন আর রাস্তায় বেরোতে পারি না। আমাকে দেখলেই ভিড় জমে যায়। বিটিভি কর্তৃপক্ষ খুব খুশি। তখন জিএম ছিলেন মুস্তফা মনোয়ার। উনি খুব আদর করে বুকে জড়িয়ে প্রশংসা করলেন। এই প্রথম নাটকে ছিল আলেয়া ফিরদৌসী, সাইফুদ্দিন, আমি এবং আরও অনেকেই।

তারপর থেকেই শুরু হলো আমার এই দীর্ঘ যাত্রা। রমজানের ঈদ এলেই আমার এই নাটক। নাটকের নাম কী, তা আর মনে থাকে না দর্শকের। দর্শকেরা সব সময়ই বলেন, আপনার জবাকুসুম রোকন দুলালের মায়ের নাটকটা ভাই জীবনে ভুলতে পারব না। ওই যে, আপনার কি যেন নাটক, ঈদের দিন জেলখানায় সেমাই খান। এই যে ভাই, ‘আপনার নাটকের নামটা তো মনে নাই, ওই যে খালি গো অ্যান্ড স্টক কন, আপনার এই গো অ্যান্ড স্টক নাটকের মতো নাটক হয় না। ভাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আপনে অনেক দিন বাইচ্যা থাকেন।’ আবার কেউ কেউ বলেন,

‘ভাই, আপনার অই নাটকটার নামটা তো কইতে পারতাছি না, মানে ওই যে, টেকা দ্যান দুবাই যামু। আহা আহারে কী দেখাইলেন ভাই, পাসপোর্টে যার ছবি, তার কল্লা কাইট্যা ওইখানে আরেকজনের কল্লা লাগাইয়া তারে বিদেশ পাঠাইয়া দিলেন, আমগো এই দেশের দুর্নীতি আপনে যে কী সুন্দরভাবে দ্যাখাইছেন, এই নাটকের কথা জীবনে ভুলব না, আমার ছেলেমেয়েরা তো ভাই সারা দিনই কয়, আব্বা, টেকা দ্যান দুবাই যামু।’

১৯৭৪ সাল থেকে এ রকম হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। নাটকের নাম মনে নেই কিন্তু সংলাপ মনে আছে। এসব সংলাপ তখন মানুষের মুখে মুখে থাকত।

আসলে বিটিভি ছাড়া তখন অন্য কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না। বিটিভিই একমাত্র ভরসা।

আমার নাটকের দর্শক ছিল সাত-আট বছর থেকে ৮০-৯০ বছরের বুড়ো-বুড়িরা। তাঁদের সবার কাছেই প্রিয় ছিলাম আমি। ঈদের দিন সন্ধ্যা হলেই ঢাকায়, গ্রামেগঞ্জে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। মনে হতো কারফিউ চলছে। কোথাও কোনো লোক নেই। সবাই এই নাটক দেখার জন্য টিভির সামনে বসে আছে। এমন জনপ্রিয় ছিল এই ঈদ সিরিজের নাটক। মূল চরিত্রে অভিনয় করতাম আমি। আমার নাম ‘জব্বর আলী’। আমার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করে জাহানারা আহমেদ। ইংরেজি আলী করত সাইফুদ্দিন। ব্যাঙ্গা চরিত্রে ফরিদ আলী। জবা কুসুম রোকন দুলালের চরিত্রে অনেকেই অভিনয় করছে। তবে প্রথম নাটকটির জবার ভূমিকায় ছিলেন সুবর্ণা মুস্তফা। ফেরদৌসী মজুমদারও একবার এই নাটকে অভিনয় করেছেন জবা কুসুম রোকন দুলালের বড় খালার চরিত্রে। আর আমার মায়ের ভূমিকায় ছিলেন আয়শা আখতার। রাজশাহীর ভাষায় অভিনয় করে আবদুল আজিজ। নাট্যকার হিসেবে টেলিভিশনের প্রথম রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পায় এই নাটক।

স্বাধীনতার পর থেকেই প্রশাসন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। দিনে দিনে তা বেড়েছে। আমার নাটকের মূল গল্পই হলো সামাজিক-প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ে। এই নাটকে ছিঁচ কাঁদুনে কিংবা রোমান্টিক কোনো ভালোবাসার গল্প থাকে না। দেশটাকে যারা নষ্ট করছে, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ঘুষ, লুটপাট করে যারা দেশটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে—এসব দুর্নীতি নিয়েই আমার নাটক। সেই ১৯৭৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছি। আগে তো শুধু বিটিভি ছিল। এখন তো অনেক চ্যানেল। এখন এই নাটক হয় প্রতিবছর চ্যানেল আইয়ে।

আটত্রিশ বছর আমার এই নাটকের বয়স। শুধু দেশের দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সব সরকারের আমলেই এই নাটক টেলিভিশনে হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো মনেপ্রাণে এই নাটকের জন্য পাগল। দেখা হলে, সব দলের রাজনীতিবিদেরাও হৃদয়ের দরজা খুলে প্রশংসা করেন। কিন্তু লাভ কী হলো? নাটক যদি সমাজের দর্পণ হয়, তাহলে তো এই নাটক দেখে দেখে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা উচিত ছিল। রাজনীতি তা পারেনি বলেই দেশের অবস্থা আজ এ রকম। উন্নতি মানেই মরীচিকা। উন্নতি মানেই লুটপাট। আমি তো ৩৮ বছর ধরে এই দুর্নীতির ওপর নাটক লিখতে লিখতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, দেশে ক্রমাগত দুর্নীতি বাড়ছে। তবু লিখে যাচ্ছি। সমাজের প্রতি লেখকের একটা দায়িত্ববোধ আছে বলেই আমার কলম থামছে না। থামবে না।