Thank you for trying Sticky AMP!!

হুমায়ূন আহমেদের ছিল নানামাত্রিক খেয়ালিপনা।

শিল্পীদের চোখে নির্মাতা হুমায়ূনের খেয়ালিপনা

হুমায়ূন আহমেদের ছিল নানামাত্রিক খেয়ালিপনা। শুটিংয়ের ফাঁকে তাঁর সেসব খেয়ালিপনা নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন অভিনেতারা। কেউ কেউ সেসব উপভোগও করতেন। চলচ্চিত্রকার, টিভি নাটক নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭২তম জন্মদিন আজ। জনপ্রিয় এই নির্মাতার পরিচালনায় বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান ও মেহের আফরোজ শাওনরা। কাছ থেকে দেখা এই মানুষটির নানা স্মৃতি ও শুটিংয়ের বাইরের মুহূর্তের ঘটনা ভাগাভাগি করলেন এই শিল্পীরা।
হুমায়ূনের বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। তাঁর লেখা নাটকে অভিনয় করে খ্যাতিও পেয়েছেন এই তারকা। হুমায়ূন আহমেদের খেয়ালিপনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, যখন নাটক লিখতেন, তখন তিনি অভিনেতাকে সেটা পড়ে শোনাতেন। কখনো কখনো অভিনয়শিল্পীদের কাছে মতামত চাইতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মত দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। তিনি এমনভাবে সবকিছু তুলে ধরতেন, সেখানে অন্যদের তেমন কিছু বলার থাকত না। তিনি বলেন, ‘তিনি লেখার সময় মনে মনে ঠিক করে নিতেন, কাকে কোন চরিত্রে অভিনয় করাবেন। সেই মানুষগুলোর কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের কথাও তাঁর মাথায় থাকত। ফলে আমাদের বলার সুযোগ না থাকলেও আমাদের কাছে তিনি মত চাইতেন।’

আসাদুজ্জামান নূর।

২০০৪-২০০৫ সালের একটি ঘটনা স্মরণ করে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘সম্ভবত কোনো এক মন্ত্রণালয়ের ফরমায়েশি একটি নাটকের কাজ করছিলেন তিনি। তেরো পর্বের সেই নাটকের শুটিং প্রায় শেষ। নাটকের প্রধান চরিত্রের যে অভিনেতা, তাঁর অভিনয় পছন্দ হয়নি হুমায়ূনের। তিনি তখন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তখন রাজনীতিতে খুব ব্যস্ত। তারপরও সময় বের করে গিয়েছিলাম। নতুন করে সেই নাটকের শুটিং করা হয়েছিল।’ হুমায়ূনের শুটিং সেটের আবহ স্মরণ করে তিনি জানালেন, শুটিংয়ে হুমায়ূন খুব গুছিয়ে কাজ করতেন, তা নয়। তাঁর সহকারীরাই সব ঠিক করে রাখতেন। তিনি কেবল দেখতেন, সব ঠিক আছে কি না। পছন্দ না হলে বদলে দিতেন। নূর বলেন, শুটিং করতে ভালো না লাগলে হুমায়ূন বলে বসতেন, ‘ধুর, আজ কোনো শুটিং হবে না। আড্ডা শুধু আড্ডা হবে।’

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘হুমায়ূনের কিছু পাগলামি ছিল। আমি সেসবে খুব একটা অংশ নিতাম না। একবার সুনীল দারা মিলে নুহাশপল্লীর সুইমিংপুলে সে কী কাণ্ড। সবকিছু তো বলাও যাবে না। আমি সেসবে অংশ নিতে খুব একটা উৎসাহ পেতাম না। আমরা হুমায়ূনের এই ধরনের পাগলামি এবং চরিত্রের অনেক কিছু মেনে নিয়েই তাঁর সঙ্গে চলতাম।’

জাহিদ হাসান

হুমায়ূনের অনেক নাটকে কাজ করেছেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। গাজীপুরের হোতাপাড়ায় ‘সবুজ ছাতা’ নাটকের শুটিংয়ের স্মৃতিচারণা করেন তিনি। জাহিদ জানান, তখন আমের মৌসুম কেবল শেষ হয়েছে। কোনো এক কারণে মন খারাপ করে বসেছিলেন তিনি। সে সময় হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে জাহিদ সেটা এড়িয়ে যেতে বলেন, আম খেতে ইচ্ছে করছে। জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমরা কথাবার্তা বলে শুয়ে পড়েছিলাম। হুমায়ূন ভাই তাঁর প্রোডাকশন ম্যানেজার মিনহাজকে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেন গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ে। রাত দেড়টার সময় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে হুমায়ূন ভাই বললেন, “জাহিদ ওঠো”। আমি বললাম, কেন হুমায়ূন ভাই। “তোমার জন্য ফজলি আম আনিয়েছি। আমের জন্য তোমার মন খারাপ।” এরপর রাত দুটো পর্যন্ত আম খেয়েছি।’

জাহিদ হাসান

২০০১ সালের একটি ঘটনা ভাগাভাগি করেন জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘একবার নেপাল গিয়েছিলাম। আমি, হুমায়ূন ভাই, গুলতেকিন ভাবি, মোশাররফ করিম, আলমগীর ভাই। নেপাল ঘুরে ভারতে। সেখানকার মার্কেটে যাই শাড়ি কিনতে। হুমায়ূন ভাই বললেন, “তুমি যেহেতু শাড়ি কিনবে, তোমার ভাবিও যাবে। কুসুমের জন্য (শাওনকে কুসুম নামে ডাকতেন) একটা শাড়ি কিনো।” বললাম, আমি কিনব কীভাবে? তিনি বললেন, “তুমি মৌয়ের জন্য শাড়ি খুঁজবা। আমি কাশি দিলে বুঝবে, ওই শাড়িটা পছন্দ হয়েছে।” আমরা শাড়ির দোকানে ঢুকলাম। কেনাকাটার একপর্যায়ে হুমায়ূন ভাই কাশি দিলেন। আমি শাড়িটা কিনে ফেললাম। হোটেলে ফেরার পর হুমায়ূন ভাই জানতে চাইলেন, “কোন শাড়িটা কিনেছ?” আমি বললাম, ওই যে কাশি দিলেন, সেই শাড়িটা। তখন হুমায়ূন ভাই বললেন, “ওটা তো আমার সত্যিকারের কাশি ছিল।” আমি তো অবাক! বললাম, কী বলেন হুমায়ূন ভাই, আমি সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় শাড়িটা কিনছি। আমার কাছে তো আর টাকাও নাই। তিনি বললেন, “তাহলে কী করবা?” আমি ভড়কে গেলাম। এই সময় তিনি বললেন, “আমি দুষ্টুমি করেছি। তোমার শাড়ি ঠিকই আছে।”’

মেহের আফরোজ শাওন

মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূনের নাটক–সিনেমার অভিনেত্রী। পরে তিনি হন হুমায়ূনের স্ত্রী। শুটিংয়ের বাইরে হুমায়ূনকে সবচেয়ে বেশি দেখেছেন এই অভিনেত্রী। শুটিং অবকাশের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘শুটিংয়ে একদিন দেরি মানেই খরচ বেড়ে যাওয়া। শিল্পীদের শিডিউলও পাওয়া যায় না। সেখানে হুমায়ূন আহমেদই মনে হয় একমাত্র পরিচালক, যিনি বাংলাদেশের খেলা থাকলে শুটিং বন্ধ করে দিতেন। সবাইকে নিয়ে খেলা দেখতে বসে যেতেন। বৃষ্টি হলেই তিনি শুটিং বন্ধ করে সবাইকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতেন।’

মেহের আফরোজ শাওন

হুমায়ূন আহমেদের শুটিং সেটের খাবারের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুটিংয়ের সময় নুহাশ চলচ্চিত্রের খাবারের প্রশংসা করেননি এমন কেউ নেই। বাংলাদেশের খেলা থাকলে স্পেশাল খাবার তৈরি হতো। তিনি বলতেন, “খাসি জবাই করো। শিল্পী বা কলাকুশলী কেউ বাদ যাবে না।” প্রতিবারই তিনি বলতেন, “বাংলাদেশ তো জিতবেই, রাতের বেলা মজার খাবার হবে।” কেউ যদি দুষ্টুমি করে বলত, যদি হারে? তিনি বলতেন, “আরে কুকথা বলো কেন? তুমি তো একটা কুফা। বাংলাদেশ জিতলে তো খাওয়া হতোই। বাংলাদেশ হারলেও খাওয়া হতো।” তখন তিনি বলতেন, “বাংলাদেশ বেশ ভালো খেলে হেরেছে, সে জন্য এই খাওয়া।’”

মাহফুজ আহমেদ।

অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ জানান, একদিন ধানমন্ডির দখিন হাওয়ার উল্টো দিকে একটি বাড়িতে শুটিং করছিলেন তিনি। হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ ফোন করে তাঁকে তক্ষুনি নিচে নামতে বলেন। মাহফুজ বলেন, ‘আমি শুটিং রেখে নিচে নামতেই তিনি আমাকে গাড়িতে উঠতে বলেন। আমি গাড়িতে উঠলে গাড়ি চলে যায় গাজীপুর নুহাশপল্লীতে। বারবার ফোন করছিলেন পরিচালক অরুণ চৌধুরী। আমি কেবলই বলছিলাম, আসছি। হুমায়ূন ভাইয়ের হাত থেকে পরে ছাড়া পাই তিন দিন পর। এটা সম্ভব হয়েছিল কেবল আদর–ভালোবাসার কারণে। এমন করে আর কেউ আমাদের ভালোবাসে না।’