Thank you for trying Sticky AMP!!

'রানি রাসমণি'র রাজচন্দ্র বাগেরহাটের নূর

গাজী আবদুন নূর

‘আমার মা কলকাতায় এসেছেন। চিকিৎসার জন্য। তাই সকালে আপনি যখন ফোন করেছেন, তখন কথা বলতে পারিনি।’ শুরুতেই দুঃখপ্রকাশ করেন গাজী আবদুন নূর। গতকাল রোববার সকালে কলকাতা থেকে তিনি নিজেই ফোন করে বললেন। জি বাংলার এ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’। এখানে তিনি ‘রানিমা’ রানি রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র দাশের চরিত্রে অভিনয় করছেন।

‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে দিতিপ্রিয়া রায় ও গাজী আবদুন নূর

‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালের জন্য শুধু ভারতের বাংলা টিভি চ্যানেলের দর্শকদের কাছেই নয়, বাংলাদেশের টিভির দর্শকদের কাছেও এখন খুব পরিচিত গাজী আবদুন নূর। শুরুতেই জানালেন, তিনি বাংলাদেশের ছেলে। বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট উপজেলায় দাদার বাড়ি আর নানার বাড়ি গোপালগঞ্জে। তাঁদের বাসা মোল্লারহাটে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা করেছেন সেখানেই। কলকাতায় যান ২০১১ সালে।

কলকাতায় ক্যানসার ও অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন গাজী আবদুন নূর

গাজী আবদুর নূর মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত হন বাংলাদেশেই। বিবর্তন যশোরের সদস্য। এই দলের হয়ে ২০১১ সালে কলকাতায় যান। অনীক থিয়েটার আয়োজিত গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে ‘রাজা প্রতাপাদিত্য’ নাটক নিয়ে অংশ নেয় বিবর্তন যশোর। ওই সময় সেখানে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। যোগাযোগ করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাটক নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে যান। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা বিভাগে ভর্তি হন। সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক শেষ করার পর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি পান। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন।

‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে কাজের ফাঁকে

বাবা গাজী আবদুল মান্নান যখন মারা যান, তখন গাজী আবদুন নূর খুব ছোট। এক সময় সংসার চালানোর ভার চলে আসে তাঁর ওপর। তাই কলকাতায় শুরু থেকেই কাজের সন্ধানে ছিলেন। শুরুতেই ক্যামেরার পেছনের কাজ। অরোরা ফিল্মস, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ১১১ বছরের পুরোনো। এখানে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ পান। গাজী আবদুন নূর বললেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক কাজ করেছে। আজকের টালিউড হওয়ার পেছনে রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট অবদান। এখানে যে চেয়ারে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন থেকে শুরু বড় বড় নির্মাতা বসেছেন, সেই চেয়ারে আমিও বসেছি। অন্য রকম অনুভূতি হয়েছে আমার মধ্যে।’

খুব বেশি দিন ক্যামেরার পেছনে কাজ করতে হয়নি তাঁকে। কারণ, একসময় তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, পেছনে নয়, ক্যামেরার সামনে কাজ করবেন। কিন্তু কলকাতার টিভি ও চলচ্চিত্রে এখন কঠিন প্রতিযোগিতা। এর মাঝে কীভাবে নিজের জন্য এতটুকু জায়গা করে নেবেন গাজী আবদুন নূর! জানালেন, শুরুতে তাঁর ইচ্ছা ছিল বড় পর্দায় কাজ করবেন। কিন্তু প্রস্তাব পেলেন ছোট পর্দার। কালারস বাংলার ‘রেশম ঝাঁপি’ আর জি বাংলার ‘বাক্স বদল’ সিরিয়ালের মূল চরিত্র। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, দুটোই গতানুগতিক গল্প।’

গাজী আবদুন নূর

‘রেশম ঝাঁপি’র অডিশনে জি বাংলার একজন গাজী আবদুন নূরকে দেখে পছন্দ করেন। ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে রাজচন্দ্র দাশের চরিত্রে অডিশন দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। কিন্তু সে কী, এই চরিত্রে অডিশন দিতে এসেছে ২০০ জন! এখানে গাজী আবদুন নূরের সিরিয়াল ১১৭। কীভাবে সম্ভব? বললেন, ‘এত দিন ড্রামা নিয়ে পড়েছি, তাই কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছিল। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি।’

রানি রাসমণির যে গল্প ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে তুলে ধরা হয়েছে, তা ২০০ বছর আগের। সিরিয়ালেও রয়েছে সেই সময়ের আবহ। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কিছু নাটকীয়তা যুক্ত করা হলেও মূল গল্প থেকে সরে যায়নি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সিরিয়ালে কাজ করতে এসে গাজী আবদুন নূর বাস্তব জীবনেও নিজেকে ‘জমিদার রাজচন্দ্র দাশ’ ভাবতে শুরু করেছেন। জানালেন, এই সিরিয়ালের কাজ শুরু করার আগে পাঁচ বছর সেই কাহিনি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সব ঘটনা আর সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার শতভাগ চেষ্টা ছিল। গবেষণা থেকে রাজচন্দ্র দাশের চেহারার ব্যাপারে যতটা ধারণা পাওয়া গেছে, সেভাবেই নিজেকে সাজিয়েছেন। সেই পুরোনো আমলের জমিদারদের সঙ্গে মিলে যায়, তেমনিভাবে গোঁফ আর দাড়ি রেখেছেন। কলকাতায় যে বাড়িতে তিনি আছেন, সেই বাড়ির জন্য তিনি সব আসবাবপত্র সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন নিলাম থেকে। সেসব আসবাবপত্র বিভিন্ন জমিদারবাড়ির।

‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবির দৃশ্য

২০০ বছর আগে কলকাতার বাবুরা যেভাবে কথা বলতেন, গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে তার কিছু রূপ। গাজী আবদুন নূর বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের ছেলে। আমাদের উচ্চারণ আলাদা। এই সিরিয়ালে কাজ করতে এসে আমি সেই বাবুদের কথা বলার ধরন আর চলাফেরা রপ্ত করেছি।’

জমিদার রাজচন্দ্র দাশের ব্যাপারে গাজী আবদুন নূর বলেন, ‘ইতিহাসের কোথাও জমিদার রাজচন্দ্র দাশের কিছু পাওয়া যায় না। সব জায়গায়ই আছেন রানিমা রানি রাসমণি। কিন্তু জমিদার রাজচন্দ্র দাশ অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। এই যেমন কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা, সড়ক নির্মাণ, ঘাট নির্মাণ, সতীদাহ প্রথা রোধ। সবাই জানেন, একজন পুরুষের সাফল্যের পেছনে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা থাকে। কিন্তু এখানে ঘটেছে উল্টোটি। স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, “আমার লোকসমাজে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি বড় হও। সবাই তোমাকে জানুক।” রাজচন্দ্র দাশ কিন্তু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকেও ঋণ দিয়েছিলেন। এমনি অসংখ্য ঘটনা যখন জেনেছি, তখন রাজচন্দ্র দাশ চরিত্রটা প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। এই মানুষটার জন্য নিজের মধ্যে একটা টান অনুভব করছি।’

‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবির দৃশ্য

সিরিয়ালের শুরুতেই সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পান রাজচন্দ্র দাশ। চরিত্রটা তখনই শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দর্শক জরিপ থেকে জানা যায়, ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালের শুরুতেই জনপ্রিয় হয় ‘রাজচন্দ্র দাশ’ চরিত্রটি। তখন জি বাংলার বিপণন বিভাগ থেকে জানানো হয়, রাজচন্দ্রকে মেরে ফেললে সিরিয়াল চলবে কাকে দিয়ে? অল্পদিনে জনপ্রিয় হওয়ায় গাজী আবদুন নূরকে শুভেচ্ছা জানায় জি বাংলার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তাঁর বাসায় ফুল আর উপহার হিসেবে পাঠানো হয় নানা কিছু।

গাজী আবদুন নূরকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন চিত্র পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। কিন্তু এখনই চলচ্চিত্রের জন্য সময় দিতে পারছেন না গাজী আবদুন নূর। বললেন, ‘সিরিয়ালটি একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে। আমাদের সপ্তাহে সাত দিনই কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু একটা চলচ্চিত্রের জন্য ন্যূনতম ১৭-১৮ দিন সময় দিতে হবে। এখন যদি আমি ছুটি নিই, তাহলে সিরিয়ালটির জনপ্রিয়তার ওপর তার প্রভাব পড়বে। তা আমি চাই না।’

পরিচালক নারগিস আক্তারের সঙ্গে গাজী আবদুন নূর

গাজী আবদুন নূরের মনে অভিনয়ের পোকাটা নাকি ঢুকিয়েছিলেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় নির্মাতা ফেরদৌস হাসান রানা। তখন গাজী আবদুন নূর যশোর থেকে ঢাকায় আসছিলেন বেড়াতে, বোনের বাসায়। বললেন, ‘আমি ক্লাস নাইনে পড়ছি। গাড়িতে পরিচয় হয় এই নির্মাতার সঙ্গে। তিনি আমাকে অভিনয়ে যোগ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। তাঁর সেই কথা আমি ভুলিনি।’

জানালেন এরই মধ্যে তিনি বাংলাদেশের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নাম ‘যৈবতী কন্যার মন’। সেলিম আল দীনের কাহিনি থেকে ছবিটি তৈরি করেছেন নারগিস আক্তার। ছবিটি আগামী ৩ আগস্ট প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা আছে। এর আগে তিনি বাংলাদেশে আসবেন, ছবিটির প্রচারণার কাজে অংশ নেবেন।