Thank you for trying Sticky AMP!!

আমার গাড়িচালকের তুলনা হয় না

বিল গেটসকে আমি নানা কারণে অপছন্দ করি। কেন করি, সে বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে বিল গেটসের একটা উক্তি শুনুন, ‘দরিদ্র হয়ে জন্ম নিলে তা আপনার ভুল নয়। তবে দরিদ্র অবস্থায় মারা গেলে তা আপনার ভুল।’

বিল গেটস লোকটাকে অপছন্দ করলেও উক্তিটা আমার মনে ধরেছে। ঠিক এই উক্তিই আমি আমার গাড়িচালককে বলেছিলাম। অনেক দিন আগের কথা, সেই ২০০৯ সালের সুন্দর এক সকালে। আমি সেদিন দপ্তরপ্রধান হিসেবে যোগ দিলাম নতুন অফিসে। আমার গাড়িচালক ফুলের তোড়া, এক হালি মাছ, দুই বোতল ঘি আর চারটি মধুর বয়াম নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমার কক্ষের সামনে। সেদিনই বুঝেছিলাম, ওকে দিয়ে হবে এবং আপনারা জানেন, ওকে দিয়ে হয়েছে। মানুষের কাছে আজ ও আইডল।

প্রথম শিক্ষাসফর

আমার গাড়িচালক কীভাবে আইডল হয়ে উঠল, তা আর বিতং করে বলার কিছু নেই। তবে কিছু গোপন সূত্র আমি জানি। শুরুর দিকের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা যাচ্ছিলাম এক মফস্বল শহরে। রাজধানীর শেষ মাথায় যেখানে বড় বাসস্ট্যান্ড, সেখানে বাধল প্রচণ্ড যানজট। যানজটে পড়লে যা হয়, গাড়ির জানালার ওপাশে কিছুক্ষণ পরপর কিছু লোক এসে হাত বাড়াতে লাগল আর ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, ‘দুইটা টলার দেন, ছার! দুইটা টলার দেন, ছার!’

এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আমার গাড়িচালক বাইরে বেরিয়ে লোকগুলোকে ডাকল। ততক্ষণে যানজট হালকা হয়ে এসেছে। গাড়িটাও দিব্যি চলছিল। অথচ সে ওই লোকদের গাড়ি ঠেলার হুকুম দিল। আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, ‘ব্যাপার কী, ড্রাইভার?’

গাড়িচালক শুধু হাসল। মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর রেগেই গেলাম, ‘হচ্ছেটা কী?’

আমার গাড়িচালক বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল, ‘স্যার, পাঁচ শটা টলার দেন। ওরা পাঁচজন গাড়ি ঠেলছে, প্রত্যেককে এক শ করে দিতে হবে।’

‘কিন্তু গাড়ি তো ঠিকই আছে, ওরা অহেতুক গাড়ি ঠেলল, আর এ জন্য পাঁচ শ টলার দিতে হবে?’

‘স্যার, গাড়ি ঠিক আছে কি নাই, সেইটা আমি ভালো বুঝতেছি। স্টিয়ারিং তো আমার হাতে। আপনি বুঝবেন না। টলার দেন, স্যার; ওদের বিদায় করি। নাইলে আবার ঝামেলা করবে।’

আমি বাধ্য হয়ে পাঁচ শ টলারের একটা চকচকে নোট বের করে দিলাম। আশ্চর্যের বিষয়, আমার গাড়িচালক সেই নোট রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে ভাঙিয়ে চার শ টলার পকেটে রেখে দিল। বাকি এক শ টলার দিল গাড়ি ঠেলা লোকদের হাতে!

রাগে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, ‘এটা কী হলো?’

আমার গাড়িচালক রিয়ারভিউ মিররে আমার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে গালভরা হাসি হেসে বলল, ‘এটা স্যার নিয়োগ–বাণিজ্য।’

আমি রাগে ফেটে পড়লাম, ‘মানে তুমি আমার টলার মেরে বাণিজ্য করবে আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব!’

এবারও গাড়িচালকের মুখে হাসি, ‘দেখতে তো হবেই, স্যার। আপনি এখন খালি হাতে যাইতেছেন, ফেরার সময় ব্যাগ ভর্তি টলার নিয়া আসবেন; আমিও কিন্তু সব দেখব। দেখব না?’

বিষয়টি নিয়ে আমি আর কথা বাড়ালাম না। সেটা ছিল আমার গাড়িচালকের সঙ্গে প্রথম শিক্ষাসফর।

গন্তব্যস্থলে গিয়ে গাড়িচালককে একপাশে ডেকে নিয়ে বললাম, ‘ঘটনা কী? তুমি বারবার ওদের কাছ থেকে টলার নিচ্ছিলে কেন? আর টলার দিয়ে ওরা সামনেই–বা বসছিল কেন?’ আমার গাড়িচালক একগাল হেসে বলল, ‘এটা স্যার বদলি–বাণিজ্য। সামনের সিটে বসলে খোলা জানালার হাওয়া খাওয়া যায়, তাই ওরা সামনে বসতে চায়। আমি সেই সুযোগটা কাজে লাগাইলাম। হে হে।’

দ্বিতীয় শিক্ষাসফর

দিনটি ছিল ভয়াবহ। বর্ষাকাল। জঘন্য বৃষ্টি। অথচ ভ্যাপসা গরম। তার ওপর আমার গন্তব্য ছিল নোয়াল্যান্ডের প্রত্যন্ত এক এলাকায়। অতিবৃষ্টিতে ওই এলাকায় রাস্তাঘাটের কোনো চিহ্ন ছিল না। এদিকে আমার শখের গাড়িটা ছিল ঝাঁ–চকচকে। ফলে সেটা রেস্টহাউসে রেখে আমরা একটা মাইক্রোবাস নিতে বাধ্য হলাম। প্রত্যন্ত ওই এলাকায় আমার যাত্রাসঙ্গী হিসেবে যোগ দিল তিনজন অফিস সহকারী। নিম্নপদস্থদের সঙ্গে একই গাড়িতে ওঠার নিয়ম আমাদের নেই। কিন্তু সেদিন আমি নিরুপায়।

যাহোক রেস্টহাউস থেকে যাত্রা শুরু হলো। ভয়াবহ কর্দমাক্ত গ্রামীণ পথে নামতেই মাইক্রোবাসের এসি গেল বিগড়ে। প্রচণ্ড গরমে আমার নাভিশ্বাস উঠে গেল। দরদর করে ঘামছি। তাই আমি বাইরের হাওয়া গায়ে লাগানোর জন্য গাড়ি থামাতে বললাম। মিনিট দশেক হাওয়া খাওয়ার পর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, খেয়াল করলাম, আমার গাড়িচালক এক অফিস সহকারীর কাছ থেকে কুড়ি টলার নিয়ে পকেটে চালান করে দিল এবং যে টলার দিল, সে পেছনের আসন থেকে একেবারে সামনের আসনে গিয়ে বসার সুযোগ পেল! ব্যাপার কী? এদিকে সামনের আসনে যে বসে ছিল, সে মুখ ভোঁতা করে গেল পেছনে।

গরমে ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামানোর মতো ফুরসত পেলাম না। কোট–টাই আর জুতা খুলেও স্বস্তি নেই। তাই কিছু দূর যাওয়ার পর আবার গাড়ি থামাতে বললাম। হাওয়া খেয়ে গাড়িতে ওঠার সময় খেয়াল করলাম, এবার আমার গাড়িচালক মাঝের আসনে বসা তৃতীয় অফিস সহকারীর কাছ থেকে কুড়ি টলার নিল এবং তাকে সামনের আসনে বসার সুযোগ করে দিল। পুরো পথে আমি আর কিছু বললাম না। গন্তব্যস্থলে গিয়ে গাড়িচালককে একপাশে ডেকে নিয়ে বললাম, ‘ঘটনা কী? তুমি বারবার ওদের কাছ থেকে টলার নিচ্ছিলে কেন? আর টলার দিয়ে ওরা সামনেই–বা বসছিল কেন?’

আমার গাড়িচালক একগাল হেসে বলল, ‘এটা স্যার বদলি–বাণিজ্য। সামনের সিটে বসলে খোলা জানালার হাওয়া খাওয়া যায়, তাই ওরা সামনে বসতে চায়। আমি সেই সুযোগটা কাজে লাগাইলাম। হে হে।’

সেদিন আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ, এক মাস আগের প্রথম শিক্ষাসফরে আমার গাড়িচালক যে শিক্ষা দিয়েছিল, তা দিব্যি মনে ছিল। সব চেপে গেলাম।

শেষ কথা

শুরুতেই বলেছিলাম, বিল গেটসকে আমি অপছন্দ করি। প্রশ্ন হলো, কেন করি? কারণ, বিল গেটস বা তাঁর মতো মানুষেরা গাধাশ্রেণির। এত কষ্ট করে ধনী হয়ে কী লাভ? আমার গাড়িচালককে দেখুন। ওর কী নেই? নোয়াল্যান্ডের রাজধানীতে ওর ৫টা বাড়ি, ৩০টা ফ্ল্যাট, ৪টা গাড়ি। রাজধানীর বাইরে ওর ৩টি খামার। ওর চৌদ্দগুষ্টির আত্মীয়স্বজন সরকারি চাকরি করছে; সব ও–ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এমনকি ওর স্ত্রীও একাধিক। অথচ আমার গাড়িচালক কিন্তু মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোয়নি। ও এত বিত্তশালী হয়েছে সেই যে নিয়োগ আর বদলি–বাণিজ্য করে। এ জন্য ওকে পড়াশোনা করতে হয়নি, গবেষণা করতে হয়নি, পরিশ্রম করতে হয়নি, কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবনও করতে হয়নি।

আজ আপনারা আমার গাড়িচালককে দেখে আপনাদের সন্তানদের গাড়িচালকই বানাতে চাইছেন। এটা ঠিক যে ও আইডল, সবাই ওকে অনুসরণ করবে। তবে আমার পরামর্শ হলো, আপনারা আপনাদের সন্তানদের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ারই বানান। কারণ, সবাই আমার গাড়িচালকের মতো প্রতিভা নিয়ে জন্মায় না। আমার গাড়িচালকের মতো মানুষ কোটিতে একজন হয়। আমার গাড়িচালককে আমি এখন ‘স্যার’ বলে ডাকি। আমার গাড়িচালকের তুলনা হয় না।

হোসে জিমুনির

সাবেক দপ্তরপ্রধান, স্বাস্থ্য

পিপলস রিপাবলিক অব নোয়াল্যান্ড

*নোয়াল্যান্ড: কাল্পনিক রাষ্ট্র

**টলার: কাল্পনিক মুদ্রা

***রচনাটি পুরোপুরি কাল্পনিক। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক বা সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

Also Read: যেভাবে উত্থান আবদুল মালেকের