Thank you for trying Sticky AMP!!

জনগণের আরও টাকা খালের পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে হলেও আরেকটি সেতু চাই

সেতুর পর আর সড়ক নেই। আছে বেসরকারি একটি আবাসন প্রকল্পের জমি। সম্প্রতি রাজধানীর মান্ডার শেষ মাথা এলাকায়

চারপাশে বেশ সবুজ। দূরে যদিও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কিছু ভবন বা ইমারত চোখে পড়ে। তবু ইট-কাঠকে কোণঠাসা করে সেখানে সবুজের সমারোহই বেশি। মানুষের বসতি খুব একটা চোখে পড়ে না। বাংলা সাহিত্যের গল্প-উপন্যাস বিবেচনায় নিলে বলা যায়, এর অভিধা দেওয়া যায় ‘জংলা জায়গা’। জনমানুষে প্রচলিত সেই জায়গার নাম ‘শেষ মাথা’। ছবিতে অন্তত এই নামকরণের সার্থকতা প্রমাণিত।

বাংলা থ্রিলার বা অদ্ভুতুড়ে গল্পের প্লট আঁকার জন্য রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মান্ডার এই ‘শেষ মাথা’ আপাত বিবেচনায় আদর্শ স্থান। খবরে প্রকাশ, সেখানে এখনো মানুষের বসতি গড়ে ওঠেনি। চলাচলের সড়কও নেই। তবে গাছগাছালি আছে বেশ। আছে খাল। আর আছে সেই খালের ওপর নির্মীয়মাণ সেতু। এই সেতু নিজেই একটি অদ্ভুতুড়ে গল্পের প্লট হতে পারে আসলে। শেষ মাথাকে প্রকৃতপক্ষে ‘শেষ’ হতে না দেওয়া ও তার ব্যাপক পরিচিতির জন্য তো এই সড়কবিহীন একাকী দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটিই দায়ী। কেন এই সেতু এমন জনবিরল স্থানে বানানো হচ্ছে, তা নিয়েই তো দুর্দান্ত সায়েন্স ফিকশন লেখা যেতে পারে। মানুষের জন্য নয়, বরং ভিনগ্রহের এলিয়েনদের চলাচলের সুবিধার জন্য এ দেশে একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে—সে কল্পনা কি করা যেতে পারে না?

সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনামে অবশ্য সংশ্লিষ্ট একটি সম্পূরক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তা হলো ‘কার জন্য সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতু’। এ থেকে আমরা জানতে পারলাম, সেতুটি নির্মাণে কত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। খবরে জানা গেছে, খালের ওপর নির্মিত এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৩০ মিটার, প্রস্থে ৯ দশমিক ৮ মিটার। সেতুতে ওঠানামা করতে ৪৫ মিটার করে ৯০ মিটার সংযোগ সড়কও রয়েছে। সেতুটি বানাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও এলাকা বিবেচনায় সেতু নির্মাণে ব্যয় ঢের বেশি বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিতেই সেতুর অস্বাভাবিক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ধরনের একটি সেতুর নির্মাণ ব্যয় বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী কোনোভাবেই তিন কোটি টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

অর্থাৎ সেতুটি নির্মাণে প্রায় আড়াই কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। তবে শুধু যে বেশি টাকায় একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। এতে পুরো প্রকল্পটির ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়েই একটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারি একটি আবাসন প্রকল্পের জন্য জনগণের করের টাকায় এই সেতু নির্মাণ করে দিচ্ছে ডিএসসিসি। এই যে বেসরকারি খাতের জন্য সরকারি প্রশাসকদের এত প্রেম, এত ভালোবাসা—এর কি কোনো মূল্য নেই? তা না ভেবে শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ! আচ্ছা, মানুষে মানুষে সদ্ভাব সহ্য হয় না, না?

হয়তো দুই পক্ষে দেওয়া-নেওয়া কিছু হয়েছে। তা কি আর এই বঙ্গে উদ্ভট কিছু? আসল বিষয় হলো মানবে মানবে প্রেমভাবের সৃষ্টি এবং পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাওয়া। কবিগুরু তো সেই কবেই বলে গেছেন, ‘...দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে...।’ এখন সেটিকে যদি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জীবনে চলার পথে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেই থাকেন এবং কাউকে না ফিরিয়ে মিলে যেতে চান, তবে ক্ষতি কী?

‘শেষ মাথায়’ একা একা দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির একাকিত্ব ঘোচানোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এমনিতেই সেখানে মানুষ নেই। এখন আরেকটা সেতুও যদি না থাকে, তবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা খুব কষ্টের হবে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় গোপাল ভাঁড়ের একটি গল্প। গোপালের তখন বয়স হয়েছে। চোখে ভালো দেখতে পান না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন তাকে বললেন, ‘কী গোপাল, গতকাল আসোনি কেন?’

গোপাল বলেন, ‘আজ্ঞে, চোখে সমস্যা হয়েছে। সবকিছু দুটি দেখি। কাল এসেছিলাম। এসে দেখি দুটি দরবার। কোনটায় ঢুকব, ভাবতে ভাবতেই...।’

এ কথার বিপরীতে কৃষ্ণচন্দ্রের ‘ইতিবাচক’ জবাব, ‘এ তো তোমার জন্য ভালোই হলো। তুমি বড়লোক হয়ে গেলে। আগে দেখতে তোমার একটা বলদ, এখন দেখবে দুটি বলদ।’

গোপালও কম যান না। বলে দিলেন, ‘ঠিকই বলেছেন মহারাজ। আগে দেখতাম আপনার দুটি পা, এখন দেখছি চারটি পা। ঠিক আমার বলদের মতোই!’

আমাদের আদতে হতে হবে গোপাল ভাঁড় বর্ণিত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো। অনেকেই হয়ে গেছি অবশ্য। তা না হলে কি আর জনবিরল স্থানে সেতু হয়? আর অল্প যাঁরা ‘রূপান্তরিত’ হতে বাকি আছেন, তাঁরাও হয়ে যান গোপাল ভাঁড়ের ‘বলদের মতো’। দোহাই লাগে!

আর হ্যাঁ, লেখা শেষ হওয়ার আগে একটি দাবি জানিয়ে যেতে চাই। ‘শেষ মাথায়’ একা একা দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটির একাকিত্ব ঘোচানোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এমনিতেই সেখানে মানুষ নেই। এখন আরেকটা সেতুও যদি না থাকে, তবে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা খুব কষ্টের হবে। অথচ খবরে জানা গেছে, নির্মাণাধীন সেতুটি পার হয়ে ওই আবাসন প্রকল্পে ঢুকে সামান্য কিছু দূর এগোলেই আরেকটি খাল রয়েছে। তার ওপর কি আরেকটি ‘সঙ্গী’ সেতু নির্মাণ করা যায় না?

প্রয়োজনে জনগণের করের আরও কিছু টাকা খালের পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে হলেও এ বিষয় বিবেচনার জোর দাবি জানিয়ে গেলাম। কারণ, টাকা হারালে জনগণকে চিপায় ফেলে আরও টাকা আদায় করা যাবে। কিন্তু নির্মীয়মাণ সেতুটি যদি একা থাকতে থাকতে বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করে, তখন তার দায় কে নেবে? কে মুছে দেবে সেতুর চোখের পানি?

একটু ভেবে দেখবেন, প্লিজ!