Thank you for trying Sticky AMP!!

মন্ত্রণালয়ে আইসা আমার বয়স ফুরাইছে

বছর দুয়েক আগে একটা কাজ নিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। মামা, খালুর ফোন ছাড়া কাজ নিয়ে গেলে যা হয়, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ডানা ছাড়াই ফাইলটা উড়ে বেড়াতে লাগল এ টেবিল থেকে সে টেবিলে।

একটা ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’ অর্থাৎ বাংলায় সৃজনশীল ভাবনা ছিল আমার। বিভিন্নজনের পরামর্শে সরকারের দারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক মন্ত্রণালয়ে ইনোভেটিভ আইডিয়ার জন্য বাজেট দেয়, জেনেই এক শুভদিনে মন্ত্রণালয় বরাবর হাঁটা দিলাম। আমার বয়স তখন ২৮। প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যায় যায় অবস্থা। কাজটা তাড়াতাড়ি শুরু করতে না পারলে তার বিয়েও ঠেকানো যাবে না।

মন্ত্রী সাহেবের পিএ বেশ অমায়িক। এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে তিনি আমার ফাইলটা মন্ত্রী সাহেবকে দেখাবেন বলে ভরসা দিয়েছেন। ফাইল দেখে প্রশংসা করলেন। বললেন, সামনের সপ্তাহে আসতে।

সামনের সপ্তাহে গিয়ে শুনি মন্ত্রী সাহেব দেশে নেই।

কবে আসবেন? জিজ্ঞেস করায় দায়িত্বে থাকা লোকটাকে বেশ বিরক্ত মনে হলো। বললেন, ‘কবে আসবে, এইটা আমি ক্যামনে বলব!’

তাহলে কে বলবে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার গেলাম। এবারেও দেখা হলো না। মন্ত্রী সাহেব এলাকায় গেছেন।

চার মাস পর ওপরওয়ালা মুখ তুলে তাকালেন। মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শুনি, পিএ সাহেব মন্ত্রীকে ফাইল দেখিয়েছেন। তিনি সাইনও করে দিয়েছেন।

নিজের ভাগ্যকে ঈর্ষা করতে ইচ্ছা করল আমার। এত সহজ! মাত্র চার মাসের যাতায়াতের ফলে আমার ইনোভেটিভ আইডিয়াটা আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। মামা, খালুর সাহায্য ছাড়াই মন্ত্রী সাহেব এ রকম একটা দুর্দান্ত আইডিয়ার মূল্যায়ন করেছেন ভেবে চোখে পানি চলে এল। দেশ আসলেই এগিয়ে যাচ্ছে।

২.

ফাইল দেখে নিরাশ হতে হলো। মন্ত্রী সাহেব সাইন দিয়ে মন্ত্রণালয়ের ডিজি বরাবর রেফার করেছেন। ডিজি বসেন ১২ তলায়। সেখানে গিয়ে রিসেপশনে ফাইল জমা দিলাম। রিসিপশনিস্ট বললেন পরে আসতে।

কতক্ষণ পরে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। তত দিনে জেনে গেছি, এখানে পরে আসেন মানে কমপক্ষে চার–পাঁচ দিন।

সপ্তাহখানেক পরে ফাইলের অবস্থা জানতে রিসেপশনে গেলাম। মধ্যবয়সী রিসিপশনিস্ট জানালেন, আমার ফাইলটা আজ সকালেই ডিজি সাহেবের পিএর কাছে পৌঁছেছে। পিএর কাছে যেতেই তিনি ফাইল পাওয়ার কথা জানালেন।

ডিজি স্যার সাইন করেছেন? জানতে চাইলাম আমি।

প্রশ্ন শুনে ভদ্রমহিলা আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘এত তাড়া কিসের? মাত্র তো ফাইল এল। স্যারের বোধ হয় কাজ নেই? ফ্রি হোক।’

‘তাহলে কবে আসব?’

‘সামনের সপ্তাহে আসেন, দেখি…।’

মাস দুয়েক পর একদিন ভদ্রমহিলার মনের বরফ গলল। সম্ভবত প্রতি সপ্তাহেই আমার মুখ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়েই তিনি সেদিন ফাইল নিয়ে গেলেন ডিজির কাছে।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কে বলে সরকারি কাজকর্ম ধীরগতির! মাত্র ছয় মাসেই কেমন একটা ইনোভেটিভ আইডিয়া পাস করিয়ে ফেললাম। দেশ আসলেই ডিজিটাল গতিতে এগোচ্ছে ভেবে খানিকটা গর্বও হলো।

ঘুম ভাঙল পিএ ভদ্রমহিলার চিৎকারে। অপেক্ষা করতে করতে সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফাইলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ডিজি স্যার আপনার ফাইলটা অতিরিক্ত সচিব স্যারের কাছে রেফার করে দিয়েছেন। নিয়ে যান।’

আবারও আশা ভঙ্গ হলো। একটু আগেও ভাবলাম, অবশেষে সুদিন ফিরছে। আইডিয়াটা আলোর মুখ দেখল। এখন নাকি আবার আরেকজনের সাইন লাগবে।

৩.

অতিরিক্ত সচিব স্যারের পিএ ফাইল নিলেন। বললেন, ‘স্যার তো ব্যস্ত। সামনের সপ্তাহে আসেন।’

সামনের সপ্তাহে গিয়ে শুনি, স্যার মিটিংয়ে। পরের সপ্তাহে আসেন। পরের সপ্তাহে গেলে দেখা যায়, স্যার ছুটিতে আছেন।

আবার দুই মাস। সেই আগের চক্রের মতোই দুই মাস আমাকে দেখে বিরক্ত হতে হতে তিনি ফাইল নিয়ে অতিরিক্ত সচিবের রুমে ঢুকলেন।

অবশেষে বুক থেকে পাথর সরল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রায় নয় মাসের মতো এই একটা কাজেই লেগে ছিলাম। অবশেষে সেই কাজটা আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। এর চেয়ে বড় স্বস্তি আর কী হতে পারে!

তবে এবারও আশার গুড়ে বালি। পিএ বেরিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার সাইন করে দিয়েছেন। যুগ্ম সচিব স্যারের কাছে নিয়ে যান।’

অনেক কষ্টে মেজাজ ঠান্ডা রেখে বললাম, ‘আবার যুগ্ম সচিবের কাছে কেন?’

তিনি তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিলেন, ‘এটাই সিস্টেম।’

৪.

দুই মাস যুগ্ম সচিবের করিডরে হাঁটাচলা করার পর একদিন ডাক পড়ল। যুগ্ম সচিব ভালো মানুষ। আইডিয়াটার প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘আমি সাইন করে দিয়েছি। উপসচিবের কাছে নিয়ে যান।’

৫.

প্রেমিকা ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বলছে, ‘এসব ইনোভেটিভ আইডিয়া–ফাইডিয়া ছেড়ে অন্য কিছু করো। না হলে আমাকে হারাবে।’

তত দিনে আমারও জেদ চেয়ে গেছে। যায়, যাক। প্রেমিকা গেলে প্রেমিকা আসবে, এই সিস্টেমের শেষ দেখে ছাড়ব।

গেলাম উপসচিবের কাছে। পিএ জানালেন, স্যার মিটিংয়ে আছেন। ফাইল রেখে যান। বুঝলাম, আবার দুই মাসের চক্র।

দুই মাস পর উপসচিব ডাকলেন। আইডিয়ার প্রশংসা করলেন। বললেন, কাজ হবে।

খুশি হয়ে বললাম, ‘স্যার, তাহলে বাজেট দিন। কাজ শুরু করি।’

তিনি বললেন, ‘বাজেটের জন্য তো মন্ত্রী সাহেবের সাইন লাগবে।’

‘তাহলে সাইন নেন।’

‘একটা প্রজেক্ট নিয়ে তো স্যারের কাছে যাওয়া যায় না। বুঝতেই পারছেন। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। আরও কিছু প্রজেক্ট জমলে একসঙ্গে মন্ত্রী সাহেবের সাইন নেব।’

৬.

গার্লফ্রেন্ডের তত দিনে বিয়ে হয়ে গেছে। পাত্র বিসিএস ক্যাডার। এদিকে আমারও বয়স হয়ে যাচ্ছে। বাসা থেকে একপ্রকার জোর করেই পাত্রী দেখাতে নিয়ে গেল। পাত্রীপক্ষের এক মুরুব্বি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলে কি বিসিএস ক্যাডার?’

ঘটক বুদ্ধি করে উত্তর দিলেন, ‘ছেলে বিসিএস ক্যাডার না হলেও যে কাজ করে সেই কাজে বিসিএস ক্যাডারদের সই লাগে। বোঝেন নাই বিষয়টা?’

তাঁরা কী বুঝল কে জানে। আমার বিয়ে ঠিক হলো। কথা হলো, আমার প্রজেক্টটা মন্ত্রণালয় থেকে পাস হওয়ামাত্রই ধুমধাম করে বিয়ে হবে। এই তো কয়টা মাত্র দিন। সাইন হলো বলে।

তত দিনে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার এক বছর পার হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয়ের অলিগলি চেনা হয়েছে। উপসচিব ব্যস্ত আছেন জেনেও মন্ত্রণালয়ে যাই। পিএ চা–টা খাওয়ান। উপসচিব স্যার কবে ফাইল নিয়ে মন্ত্রীর কাছে যাবেন, জিজ্ঞেস করলে পিএ হাসেন, প্রসঙ্গ পাল্টান।

৭.

পাত্রীপক্ষ আমার ফাইল পাসের অপেক্ষায় থাকল না। তার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। আমি সংসার শুরু করলাম। ওদিকে উপসচিবের ফাইল দেখানোর সময় হলো না। এভাবেই চলছিল। একদিন ওপরওয়ালা মুখ তুলে তাকালেন। একই দিনে ঘরে নতুন অতিথি আসার খবর পেলাম, মন্ত্রণালয় থেকেও টেলিফোন করে আমাকে দেখা করতে বলল। যাক, অবশেষে আমার কাজের মূল্যায়ন হলো ভেবে বন্ধু–স্বজনদের মিষ্টিমুখ করালাম।

নির্দিষ্ট তারিখে উপসচিবের দপ্তরে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে রাগে–দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিল। পিএ জানালেন, আগের উপসচিব সম্প্রতি বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে গেছেন। নতুন উপসচিব স্যার, আগের উপসচিবের কাজের দায়ভার নেবেন না। পিএ সাহেব আমার হতাশামাখা মুখ দেখে উদ্ধারের পথ বাতলে দিলেন। বললেন, ‘আবার ডিজি বরাবর নতুন করে ফাইল জমা দেন। আপনার আইডিয়াটা যেহেতু ভালো, কাজ হয়ে যাবে। বিশ্বাস রাখেন।’

কোনো উপায় না পেয়ে আমি বিশ্বাস রাখলাম। এর শেষ দেখতেই হবে।

৮.

ছেলের নাম রেখেছি সজীব। ছেলেটা আজ স্কুলে যাবে। আমার একমাত্র সন্তান। বউ বলল, ‘স্কুলে আজ ওর প্রথম দিন। তুমি নিজে ছেলের সঙ্গে ক্লাসে বসে থাকবা। না হলে ভয় পাবে।’

এদিকে মন্ত্রণালয়েও যাওয়া দরকার। স্ত্রীকে সে কথা বলতেই ঝামটা মেরে বলল, ‘বিয়ের আগে থেকেই তো শুনছি মন্ত্রণালয়ে যাও। কই, এখনো তো তোমার আইডিয়া পাসের খবর নাই। তার চেয়ে নিজের ছেলেকে সময় দাও। দেখবা, সজীবই একদিন সচিব হয়ে তোমার ফাইল সই করে দেবে।’

যতই দিন যাচ্ছে, বউয়ের মেজাজ ততই চড়া হচ্ছে। কী আর করার। তাকে কীভাবে বোঝাই, গত আট বছরে তিনবার আমার ফাইল হারিয়ে গেছে। দুইবার ফাইল উইপোকায় খেয়েছে। মন্ত্রণালয়ে একটা ইনোভেটিভ আইডিয়া পাস করানো কি চাট্টিখানি কথা!

৯.

সাল ২০৫০। ঘরে আজ নতুন বউ এল। আমার ছেলের বউ। নিজের বিয়েতে তেমন আনন্দ করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, মন্ত্রণালয়ের কাজটা হয়ে গেলে ছেলের বিয়েতে বেশ ধুমধাম করব। তা আর হলো কই? আমার বয়স হয়ে গেছে। শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। রোগশোক লেগেই থাকে। তার ওপর রোজ মন্ত্রণালয়ে যাওয়া, ফাইলের খোঁজখবর করা সহজ কথা নয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবারই ফাইলটা সাইনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রায়। শেষ মুহূর্তে হয় উপসচিবের বদলি, নয়তো সচিবের মৃত্যু—এ রকম কারণে বাদ পড়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। ডিজি থেকে শুরু করে সচিব চক্র পার হয়ে মন্ত্রী সাহেব পর্যন্ত যেতে যেতে এক–দেড় বছর চলে যায়। একবার প্রায় সব ঠিকঠাকমতোই হয়েছিল। জায়গামতো ফাইল পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু সেবার অর্থবছর শেষের দিকে হওয়ায় ফান্ড ছিল না। নতুন অর্থবছরে আবার নতুন করে ফাইল জমা দিতে হয়েছে।

এদিকে ছেলেটাও হয়েছে ওর মায়ের মতোই রাগী। প্রায়ই আমার সঙ্গে রাগারাগি করে। আমার জন্য নাকি ওর শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে লজ্জা করে। ওর এক চাচাশ্বশুর দুই বছরের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে কাজ পাস করিয়েছে। অথচ আমি ৩০ বছর ধরে নাকি মন্ত্রণালয়ে হাঁটাহাঁটি ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি।

আজকালকার জেনারেশন যা হয়েছে না। কথায় কথায় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তুলনা করে মা–বাবাকে হেনস্তা করতে ছাড়ে না।

১০.

সাল ২০৫৭। দুই–দুইটা বাইপাস সার্জারির ধকল শরীর নিতে পারেনি। ডাক্তাররা শেষ বলে দিয়েছেন। বিছানা থেকে উঠতে পারি না। যেকোনো সময় শেষনিশ্বাস ফেলব। উকিল এসে গেছে। আশপাশের দুই–চার বাসার মানুষ এসেছে। উকিল সাহেব দলিল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কখন কী হয় ঠিক নেই। বাঁচা–মরা তো সব ওপরওয়ালার হাতে। এই অবস্থায় দলিল করে যাওয়াটাই ভালো।’

আমার বউয়েরও দেখলাম আপত্তি নেই। শুয়ে শুয়েই সাইন করলাম। সাইন করার আগে ছেলেকে পাশে বসিয়ে হাতটা ধরলাম। বললাম, ‘কথা দে বাবা, সপ্তাহে তুই অন্তত একবার হলেও মন্ত্রণালয়ে যাবি। আমার ফাইলটা সাইন করিয়ে আনবি। মনে রাখবি, এ তোর বাবার শেষ আদেশ।’

ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কথা দিচ্ছি, বাবা। যত দিন তোমার ফাইল সাইন না হবে, তত দিন আমি মন্ত্রণালয়ে যেতেই থাকব, যেতেই থাকব।’

ছেলের কথা শুনে আনন্দে চোখে পানি চলে এল। ফাইল পাস না হয়ে যাবে কোথায়!