মা–বাবার যে রোগের ভ্যাকসিন আজও অনাবিষ্কৃত
ধ্রুবদের স্কুলে কোনো পর্বত না থাকলেও আজ একজন পর্বতারোহী এসেছেন (পর্বত যে একেবারেই নেই তা নয়। ক্লাস নাইনের শান্ত ভাইকে সবাই ‘পর্বত’ বলে খ্যাপায়)। পর্বতহীন একটা স্কুলে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পর্বতারোহী কী করবেন, তা বোঝার চেষ্টা করছে ধ্রুব। একটু পরই অবশ্য ঘটনা বুঝতে পারল সে। যাঁরা পাহাড়ে উঠতে আগ্রহী, তাঁদের নিয়ে একটা ক্যাম্পের মতো হবে। পর্বতারোহী ও তাঁর দল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, দড়ি এসব দেখাবেন, কোনটা কী কাজে লাগে তা নিয়ে ধারণা দেবেন সবাইকে। পর্বতে ওঠার তেমন ইচ্ছা নেই ধ্রুবর। সে দূরে দাঁড়িয়ে সবার হইচই দেখছিল। এমন সময় তার মা শায়লা পারভীন এসে বললেন, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ক্যাম্পে যাও।’
: গিয়ে কী করব?
: কী করবে মানে? দেখছ না, সবাই কী সুন্দর ওই বোর্ড-পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছে! যাও, তুমিও ওঠো।
: ওটা তো নকল পাহাড়। নকল পাহাড়ে উঠে কী হবে?
: মুখে মুখে তর্ক করবে না। যাও।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্যাম্পে নাম লেখাল ধ্রুব। মা ওর সঙ্গেই ছায়ার মতো ঘুরঘুর করছেন। লম্বা একটা বোর্ড। তাতে ধরা আর পা রাখার জায়গা বানানো আছে। খাঁজে পা রেখে বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। কাজটা খুব বেশি কঠিন নয়। কিন্তু ধ্রুব নার্ভাস হয়ে গেল। একটু দূরে মা দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রমাগত চিত্কার করছেন তিনি, ‘কী ব্যাপার, উঠছ না কেন? আহা, এখানে পা রাখো...আরে...জিনিসটা ধরো ভালো করে...!’
ধ্রুব বলল, ‘ঠিকমতো ধরতে পারছি না তো। হাত ঘামছে। পিছলে যাচ্ছে।’
: এখানে উঠতে গিয়ে আর কারও হাত তো ঘামে না, তোমারটা ঘামছে কেন? আশ্চর্য!
: আমি কী করব?
ইন্সট্রাক্টর বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই, বাবু। তুমি আস্তে আস্তে নামো।’
নেমে এল ধ্রুব। শায়লা বিরক্তমুখে ওর কাছে এগিয়ে গেলেন, ‘সামান্য জিনিসটায় উঠতে পারলে না? সবাই তরতর করে উঠে গেল! বাড়িতে তো ঠিকই আলমারি, বুকশেলফ বেয়ে ওঠো!...এখন যাও, ওই যে এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী! তাঁর অটোগ্রাফ নাও। বলো, তুমি তাঁর ভক্ত। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।’
ধ্রুব বাধ্য ছেলের মতো অটোগ্রাফ নিতে গেল। স্মার্টফোন হাতে শায়লাও গেলেন পেছন পেছন। পর্বতারোহীকে বললেন, ‘আমার ছেলে তো আপনার অনেক বড় ভক্ত।’
: তাই নাকি? তো তুমি এভারেস্টে উঠতে চাও? মাউন্টেনার হবে?
: না। ওখানে অনেক ঠান্ডা। আর ক্রিকেটও খেলা যায় না। আমি ক্রিকেটার হব। সাকিবের মতো।
শায়লা থতমত হাসি হেসে বললেন, ‘দুষ্টুমি করছে। দুষ্টু হচ্ছে দিন দিন।’
স্কুল থেকে ফিরে কোচিংয়ে যায়। রাতে আবার একজন টিচার আসে পড়াতে। এর বাইরে শুধু গান আর ছবি আঁকা শেখে। গিটারটা শেখানোর চেষ্টা করছি, আগ্রহই নাই। সুযোগ পেলেই ব্যাট–বল নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
কিছুক্ষণ পর অভিভাবকদের রুমে গেলেন শায়লা। তাঁকে দেখেই এগিয়ে এলেন রিমা ভাবি। তাঁর ছেলে অমিতও ধ্রুবর ক্লাসেই পড়ে। রিমা বললেন, ‘কী ব্যাপার ভাবি, ধ্রুব দেখলাম বোর্ডটায় উঠতেই পারল না!’
: কেন যে এত বোকা আর ভিতু হচ্ছে ছেলেটা!
: আমার অমিত কিন্তু পাঁচ মিনিটেই উঠে গেছে। দেখেছেন তো?
: হ্যাঁ।
: ওকে কারাতে কোর্সে ভর্তি করে দিয়েছি তো, খুব চটপটে। পুরস্কারও পেয়েছে কয়েকটা। কদিন পর ব্ল্যাকবেল্টও পাবে।
: তাই?
: হ্যাঁ, ভাবি। দেশের যা অবস্থা, কারাতে না শিখে উপায় কী? এই সেদিন ছিনতাইকারী আমাদের বাড়িওয়ালার কাছ থেকে টাকাপয়সা সব নিয়ে গেল। একেবারে বাসার সামনে।
: কী ভয়ংকর!
: হ্যাঁ। ধ্রুবকে কোথাও ভর্তিটর্তি করাননি? কো–কারিকুলাম অ্যাকটিভিটি তো খুব জরুরি।
: সময় কই? স্কুল থেকে ফিরে কোচিংয়ে যায়। রাতে আবার একজন টিচার আসে পড়াতে। এর বাইরে শুধু গান আর ছবি আঁকা শেখে। গিটারটা শেখানোর চেষ্টা করছি, আগ্রহই নাই। সুযোগ পেলেই ব্যাট–বল নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
: আমারটাও। আমি অবশ্য কড়া শাসনে রাখি। শাসন না করলে পোলাপান মাথায় উঠে যায়! আজ যাই, ভাবি। ওর আবার কারাতে ক্লাস আছে।
রাতে স্বামীর কানে কথাটা তুললেন শায়লা। স্ত্রীর কথা শুনে প্রায় আঁতকে উঠলেন আজাদ, ‘কী বলো, কারাতে কোর্সের কোনো দরকার নেই!’
: কেন?
: আরে, আমি ওকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার এক কোর্সে ভর্তি করাব। ফর্মও এনে রেখেছি। কুংফু–কারাতে শিখে ছেলে মাস্তান হবে নাকি?
: আশ্চর্য! আত্মরক্ষার ব্যাপার আছে না? রিমা ভাবির ছেলে কী চটপটে। কারাতে শেখে। ব্ল্যাকবেল্ট পাবে কদিন পর। ফ্রেঞ্চ শিখে কী হবে?
: আরে ব্ল্যাকবেল্ট তো আমারও আছে। আমার সব বেল্টই তো ব্ল্যাক। এর জন্য কারাতে শিখতে হয়? শোনো, বিদেশি একটা ভাষা জানা থাকা ভালো। কাজে লাগে। তা ছাড়া তোমার ছেলে পটাপট ফ্রেঞ্চ বলছে, স্ট্যাটাসটা কোথায় দাঁড়াবে ভেবে দেখেছ? আকরাম সাহেবের ছেলেটা জার্মান শিখছে। সেদিন আমাকে দেখেই বলল, ‘উই গেত এস দিয়ার?’ মানে ‘আপনি কেমন আছেন?’ হিটলারও এত স্পষ্ট জার্মান বলত কিনা সন্দেহ আছে।
: তাই নাকি?
: হ্যাঁ। জার্মান এমবাসিতে নাকি প্রায়ই প্রোগ্রাম করে। ছড়াটরা পড়ে বোধ হয়। এরস্টাউনলিখ ব্যাপার!
: কী?
: মানে দারুণ ব্যাপার। জার্মান ভাষা! সুইট না?
: ঢং কোরো না। এক কাজ করি। ওকে কারাতে আর ফ্রেঞ্চ দুটোতেই ভর্তি করিয়ে দিই। দুটোর ক্লাস তো আর এক দিনে হবে না।
: এরস্টাউনলিখ! কালই ব্যবস্থা করছি।
অতঃপর কারাতে আর ফ্রেঞ্চ কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল ধ্রুব। সঙ্গে কোচিং, প্রাইভেট, গান আর ছবি আঁকা শেখাও চলতে লাগলো মহা সমারোহে। কয়েক মাস পর পরীক্ষার খাতা বাসায় নিয়ে এল সে। খাতা দেখে শায়লা বলল, ‘অঙ্কে ২৫–এ ২২। নট ব্যাড। এটা কি হায়েস্ট মার্ক?’
: না, মা। জামি আর বাবু ২৩, হিমেল ২৪। হায়েস্ট পেয়েছে সৌরভ! ২৫–এ ২৫।
: আর তুমি মোটে ২২? লজ্জা করে না? তুমি ভাত খাও, ওরাও খায়। তাহলে ওরা ২৪-২৫ পায়, তুমি পাও না কেন? কী করো সারা দিন? কখনো তো মনে হয় না, একটু অঙ্কটা করি! ছি! মানুষের ছেলেমেয়ে পঁচিশে ২৫ পায়, আর আমার ছেলে হয়ে তুই পাস ২২! আজ আসুক তোর বাপ! বুঝবি মজা।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন আজাদ। সঙ্গে তার ছোট ভাই—ধ্রুবর প্রিয় ছোট চাচা। ভাতিজার জন্য চকলেট এনেছেন। কিন্তু ঘরে ঢুকেই টের পেলেন পরিস্থিতি থমথমে। একটু পর পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন শায়লা। শুনে ভীষণ খেপে গেলেন আজাদ। স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, অঙ্কের জন্য আরেকজন টিচার রাখবেন। হাইয়েস্ট মার্ক পেতেই হবে ধ্রুবকে।
রাতে শোবার আগে ধ্রুব ওর ছোট চাচাকে বলল, ‘চাচা, মা–বাবা আমাকে সব কিছু জোর করে শেখাতে চায় কেন?’
ছোট চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এটা তোর মা–বাবার একটা রোগের মতো হয়ে গেছে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এ রোগের ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি।’