Thank you for trying Sticky AMP!!

অংয়ের গল্প

অং রাখাইনের তৈরি চাকমা ভাষার ছবি মর থেংগারির দৃশ্য

সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরেননি বাবা। অং রাখাইন ছোট্ট বয়সেই নামলেন জীবনসংগ্রামে। ১০ বছরের চেষ্টায় তৈরি করলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘মর থেংগারি’। পড়ুন এক তরুণের সফলতার অনন্য গল্প।

পাহাড়ে ঘেরা গ্রাম। সেই গ্রামে এসেছে একটি বাইসাইকেল। যাকে চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘থেংগারি’। সেই সাইকেলের দিকেই উৎসুক পাহাড়বাসীর চোখ। কেউ এই সাইকেলে দেখছে সচ্ছলতার আশা। কেউ আবার সাইকেলের আগমনে প্রভাব হারানোর ভয়ে শঙ্কিত। একটি সাইকেল ঘিরে নানা গল্প। এসব গল্পকে একটি ফ্রেমে বন্দী করেছেন অং রাখাইন। রাখাইন পরিবারে জন্ম নেওয়া অং ছেলেবেলা থেকে ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখেননি। কিন্তু ছবিকে নিজের চোখে জমিয়ে রেখেছেন শৈশব থেকেই। স্কুলবেলায় দেখা গল্পকেও তিনি তুলে এনেছেন তাঁর ছবিতে। কিন্তু তাঁর নিজের জীবনটা কেমন? কীভাবে দূর পাহাড়ের সেই ছেলেটি ঢাকায় এসে বনে গেলেন নির্মাতা?
পৃথিবীতে এসেই একপাশে পেয়েছেন সাগর, অন্যপাশে পাহাড়। তাই তাঁর মনে আর মাথায় গেঁথে আছে সাগর আর পাহাড়ের ছবিই। সেই ছবি চোখে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে তা দেখানোর ইচ্ছাও অং রাখাইনের ভেতর ছিল অদম্য। তাই তো চোখে লেগে থাকা পাহাড় আর পাহাড় ঘিরে বসবাস করা মানুষগুলোর ছবি তিনি শহরের কোলাহলে তুলে ধরেছেন। মর থেংগারি চলচ্চিত্র দিয়ে পাহাড়ি জনপদের মানুষের জীবনকে তিনি সবার সামনে নিয়ে এসেছেন। সেই সঙ্গে গড়েছেন ইতিহাসও। অং জানান, ‘এটিই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও উন্মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত প্রথম চাকমা ছবি।’

অং রাখাইন

কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং গ্রামে জন্ম নেওয়া ছেলেটির এই কীর্তি গড়ার গল্প কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। বুনন শুরু হয়েছে অংয়ের ছেলেবেলা থেকেই। পাহাড়ি জীবনের অনেক সংগ্রাম আর প্রতিবন্ধকতাকে অং দেখতেন গোটা অক্ষরে লেখা গল্পের মতো করে। সেই গল্পই তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। হারবাং গ্রামের দুরন্ত ছেলেটি কখনো ছবি বানাতে চাননি। তাঁর ভাষায়, ‘ছেলেবেলায় আমি এসব নিয়ে ভাবতামই না। আমি শুধু দেখতাম। কোনো কিছু ঘটলেই সবাই তাকিয়ে থাকত। কিন্তু আমি দেখতাম। তাকিয়ে থাকা আর দেখার মধ্যে কিন্তু একটা পার্থক্য রয়েছে। আমার সেই দেখার অভ্যাসটিই আমাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে।’ কোথায় নিয়ে এসেছে? ‘এই যে সিনেমার জগতে। এখন তো আমি সিনেমা বানানো ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। এই একটি ছবির (মর থেংগারি) জন্য আমি ১০ বছর সময় দিয়েছি। এখন আবারও নতুন কিছু তৈরির ইচ্ছা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’ ১০ বছর? হ্যাঁ, ১০ বছর। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়কার কথা। অং পড়তেন বান্দরবানের লামার মাতামুহুরি কলেজে। সে সময় দেখেছিলেন, সেখানে একটি সাইকেল ঘিরে পাহাড়ি মানুষের উৎসাহ আর কৌতূহল। সেই যে একটি ছবি চোখে লেগে গেল অংয়ের, তা-ই ১০ বছর ভাবিয়ে গেল তাঁকে।
চোখের ভেতর স্বপ্ন
পড়ালেখায় মন ছিল না অং রাখাইনের। পরিবারের ছোট ছেলে তিনি। তাঁকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার মাত্রাটিও ছিল একটু বেশি। সাগরে গিয়ে অংয়ের বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা-ভাইয়েরাই হয়ে ওঠেন তাঁর সবচেয়ে বড় উৎসাহের জায়গা। ছেলে পড়ালেখা করবে চাকরিবাকরি করবে, এমনটাই ইচ্ছা ছিল মা ও ভাইবোনদের। কিন্তু অং যখন উচ্চমাধ্যমিকের কোটা পেরোতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়লেন, তাঁকে নিয়ে ভালোই দুশ্চিন্তায় পড়ল তাঁর পরিবার। তাঁর নতুন গন্তব্য তখন হলো ঢাকা। তাঁকে তাঁর বড় ভাই উচিং রাখাইন ঢাকায় নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল হোটেল ব্যবস্থাপনায় পড়াশোনা করবেন অং। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে নিয়ে গেল অন্যদিকে। হোটেল ম্যানেজমেন্টে ছাত্র ভর্তির কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায়, বড় ভাই অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই তাঁকে নারায়ণগঞ্জের আর্ট কলেজে ভর্তি করান। এরপর ধীরে ধীরে তিনি যুক্ত হন নাটকের দল প্রাচ্যনাটে। এরপর একটা সময় নারায়ণগঞ্জ চারুকলা বিভাগেই অং নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন। সেখানে দুই বছর পড়াশোনার পর ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। পড়ার ফাঁকেই একটা সময় ছোট ছোট তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ফেসবুকের মাধ্যমেই আলাপ করতে করতে একসময় নির্মাতা নুরুল আলম আতিকের দলে যুক্ত হয়ে যান। অং জানান, সেই দলে তাঁর প্রথম কাজটি ছিল প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে। এরপর ধীরে ধীরে সেই দলের প্রায় প্রতিটি বিভাগেই কাজ করেছেন তিনি। কখনো শব্দগ্রাহক, কখনো চিত্রগ্রাহক, কখনো আবার সম্পাদনার টেবিলেও বসতে হয়েছে তাঁকে।

একটি সাইকেল নিয়ে মর থেংগারির গল্প

মোটকথা, ফ্রেমে বাঁধা গল্প বানাতে প্রতিটি শাখায় ঘুরেফিরে কাজ করেছেন অং। তাই একটা সময় যখন নিজের সিনেমা বানাতে গেলেন তিনি। তখন দেখলেন তাঁর দলে তিনি একাই অনেকটা জায়গাজুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছেন।
অংয়ের ছবি মর থেংগারির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় গত বছরের ডিসেম্বরে ১৩তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও উন্মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে। এরপর এটির প্রদর্শনী হয় চট্টগ্রামে। এখন ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেই অংয়ের তৈরি ছবিটি বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে।
অং এখন নতুন কিছু তৈরি করতে চান। ১০ বছর চেষ্টার পর একটি ছবিকে দেখিয়েছেন আলোর মুখ। এবার নতুন কিছুর পালা। নতুন বলতে অং এবার পর্দায় তুলে ধরতে চান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাহাড়ি বাসিন্দাদের অংশগ্রহণকে। এখন এই ছবিকে নিজের চোখে ধারণ করে ঘুরছেন অং। সুযোগ পেলেই তাঁর চোখে বন্দী এই ছবি তুলে ধরবেন সবার চোখের সামনে।