Thank you for trying Sticky AMP!!

অন্ধকারে আলোর ছটা

রুমানা মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এখন কানাডাপ্রবাসী

প্রথম যখন শুনেছিলাম, আমি আর দেখতে পারব না, তখন আমার কেমন লেগেছিল? যতটুকু মনে পড়ে, জীবনের বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে, এটা কল্পনা করেই প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিলাম। আমার চিন্তাভাবনা বারবার বিভিন্ন মিশ্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে আমার মেয়েটাকে বড় করব, মা-বাবার দেখাশুনা করব, কীভাবে পড়াশোনা শেষ করব, কীভাবে ক্যারিয়ারে অগ্রসর হব। সবচেয়ে বড় কথা, আমি জানতাম না, কীভাবে বাঁচব।
আমার ছোট্ট মেয়েটা প্রতিদিন একটু একটু করে বড় হচ্ছে, হাসছে, তার কিছুই আমি দেখতে পারছি না, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কোনো যুক্তিতর্কই আমাকে শান্ত করতে পারছিল না। তখন আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা আমি কী করছি? আমি আমার মেয়েকে দেখতে না পেলে কী হবে! আমার মেয়ে তো আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আর আমার ভালো থাকা না-থাকার ওপরই নির্ভর করছে ওর ভালো থাকা না-থাকা। সিদ্ধান্ত নিলাম, বাকি জীবনটা নিজের ইচ্ছাতেই চলব।
আমার বাকি জীবন সুখের না দুঃখের হবে, তা অন্যের সিদ্ধান্তে হবে না। বিশেষ করে তার সিদ্ধান্তে তো নয়ই, যে আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। হ্যাঁ, আমি অন্ধ হয়ে গেছি। কিন্তু আমি এখনো আরও অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখি। তখন আমি বিক্ষিপ্ত মনটাকে স্থির করলাম। ব্রেইল শিখলাম। শুরু করলাম পড়াশোনা। মাস্টার ডিগ্রি শেষ করে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম, যা আমার জন্য একেবারেই নতুন। কিন্তু আমি ভুলে যাইনি যে আমাদের শক্তি অপরিসীম। বিপদের মুখোমুখি না হলে আমরা আমাদের সেই শক্তি সম্বন্ধে কোনো ধারণাই করতে পারি না; মাতৃত্ব আমার মধ্যে এমনই এক শক্তি এনে দিয়েছে। চারপাশের মানুষের এত ভালোবাসা ও সমর্থন আমি পেয়েছি যে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে হয়; বিশেষ করে আমার পরিবার ও বন্ধুদের কথা না বললেই নয়। প্রয়োজন হওয়া মাত্র তাদের আমি সব সময় পাশে পেয়েছি এবংএখনো পাচ্ছি। আজ মনে হয়, আমি হয়তো দুটো চোখ হারিয়েছি, কিন্তু বদলে শ খানেক চোখ পেয়েছি। তাদের ভালোবাসাই আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে এবং পেছনে না থাকাতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি কেন আলাদা না হয়ে স্বামীর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার সহ্য করেছিলাম। উত্তরটা নিজেই বের করে ফেলি, স্বামীকে ত্যাগ করলে যে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও নিগ্রহ আমাকে সহ্য করতে হতো, তা নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি তখন আমার ছিল না। আমি সব সময় আমার মেয়ে, মা, বাবা ও পরিবারের কথা ভেবেছি। আমার মেয়ে কীভাবে এটা মোকাবিলা করবে, এটা ভেবেছি। এসব ভাবনা মিলেমিশে আমাকে বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত থেকে দূরে রাখে। নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সবার কথা ভাবতে বাধ্য করে। তখন মনে হতো, বিয়ে ভাঙাটা হবে আমার জন্য ভীষণ লজ্জার। কিন্তু আজ বুঝি, এটা সেসব মানুষের জন্য লজ্জার, যারা অন্যের ওপর জঘন্য অত্যাচার করে। কখনো মনে হয়নি, আমার সেই অশান্তির জীবন আমার মেয়ের জীবনে কোনো ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে না। আমি ভাগ্যবান যে এখনো লেখাপড়া করতে পারছি। আমি জানি, প্রতিদিন অসংখ্য নারী অত্যাচারের শিকার হয়েও তা মুখ বুজে সহ্য করছেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই সফল হোক না কেন, ব্যর্থ বিয়ের বলয় ভেদ করে তাঁরা বেরিয়ে আাাসতে পারছেন না। আমি চাই না আমার মতো পরিণতির শিকার আর কেউ হোক। ও রকম অসুস্থ সম্পর্কে থাকা অবস্থায় জীবনের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন আমি অর্থবহ একটা জীবন কাটাতে চাই এবং লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমি আমার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছি যে আমি চাই, আমার মেয়ে আমাকে নির্যাতিত নারী হিসেবে নয়, জীবনযুদ্ধে জয়ী একজন নারী হিসেবে জানুক। যারা আমাদের ওপর নির্যাতন করে পদদলিত করতে চেয়েছিল, তারা কখনোই আমাদের মনোবলকে পরাজিত করেতে পারবে না। এখন সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছি। সুন্দর ও অর্থবহ একটা জীবনের জন্য আপনাদের সবার দোয়া ও আশীর্বাদ চাই। ধন্যবাদ।