Thank you for trying Sticky AMP!!

অপ্রতিরোধ্য সাবিনা

>বাংলাদেশের তরুণেরা মেলে ধরছেন নিজেদের। নানা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তারুণ্যের জয়ধ্বনি। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও ১৪২৫ নতুন বঙ্গাব্দে ‘ছুটির দিনে’ তুলে ধরছে ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, আলোকচিত্র, সামাজিক ব্যবসা, স্থাপত্য-নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল তরুণদের। অগ্রগামী এই তরুণদের জন্য আমাদের শুভকামনা। তাঁদেরই একজন খেলোয়াড় সাবিনা খাতুন
বলের সঙ্গেই সখ্য সাবিনা খাতুনের

সাতক্ষীরার নবারুণ উচ্চবিদ্যালয় কিংবা তামিলনাড়ুর সেথু এফসি—যখন যে দলের জার্সি পরে মাঠে নামেন না কেন—অপ্রতিরোধ্য সাবিনা খাতুন। দলকে জেতানোর গুরুভারটা যেন তাঁকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। সাতক্ষীরার মহিলা ফুটবল কোচ আকবর আলী তাই তো প্রথম দিন দেখেই জহুরির চোখে চিনেছিলেন সাবিনাকে।

আকবর আলী তখন সাতক্ষীরার কারিমা উচ্চবিদ্যালয়ের কোচ। আন্তস্কুল টুর্নামেন্টে কারিমা অন্য ম্যাচগুলো জিতলেও নবারুণের সঙ্গে কখনো পারত না। পুরো দলকে একাই টেনে নিয়ে যেতেন নবারুণের স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন। সাবিনার মুভমেন্ট, পাসিং, ড্রিবলিং—রীতিমতো মুগ্ধ আকবর আলী। এলাকায় নিজের ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলনের প্রস্তাব দেন সাবিনাকে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষিকারা সাবিনাকে অন্য কোথাও খেলার অনুমতিই দিলেন না। আকবর আলীও নাছোড়বান্দা। সাবিনার ঠিকানা জোগাড় করে চলে গেলেন পলাশপোল পাওয়ার হাউসের পেছনে। বাবা সৈয়দ আলী ও বড় বোন সালমা খাতুনকে বোঝালেন সাবিনার প্রতিভার কথা। সেদিন না করেননি পরিবারের কেউ। পলাশপোলের সাবিনার ফুটবল এখন মাতাচ্ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া।

বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলে অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে সাবিনার নাম। বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে বিদেশে পেশাদার লিগ খেলেছেন। মালদ্বীপেই খেলেছেন তিনবার। ভারতের মহিলা লিগের দল সেথু এফসির হয়ে খেলে এই তো ১৪ এপ্রিল দেশে ফিরেছেন। প্রথমবারের মতো ভারতের মহিলা লিগে অংশ নেওয়া সেথুকে বলতে গেলে একাই সেমিফাইনালে টেনে তোলেন সাবিনা। লিগে ৭ ম্যাচে ১১ গোল করে সেথু এফসি। এর মধ্যে ৬ গোলই সাবিনার। দলকে সেমিফাইনালে তুলতেও বড় অবদান ছিল সাবিনার। কিন্তু সেমিফাইনালে ইস্টার্ন স্পোর্টিংয়ের কাছে হেরে বিদায় নেয় সাবিনার দল সেথু এফসি। স্বপ্নের ফাইনালে খেলা হয়নি সাবিনার।

সাতক্ষীরা শহরে একসময় ভাঙারির ব্যবসা করতেন সাবিনার বাবা। পাঁচ বোনের সংসারে টানাটানি লেগেই থাকত। বড় বোন সালমা স্থানীয় ক্লিনিকে সেবিকার চাকরি নেন। তাতেও সংসার ভালোমতো চলত না। সাবিনা ফুটবল খেলা শুরুর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে সংসারের রং। ফুটবল খেলে পাওয়া টাকা তুলে দিতে থাকেন বাবার হাতে। বাবাকে এখন আর ব্যবসা করতে দেন না সাবিনা। সাতক্ষীরা শহরের চৌধুরী বাড়িতে বড়সড় ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। জমিও কিনেছেন। ফুটবলই বদলে দিয়েছে সাবিনার পৃথিবী।

২০০৮ সালে সিটিসেল জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন সাবিনা। সেবার বুড়িগঙ্গা অঞ্চলকে চ্যাম্পিয়ন করতে তাঁর অবদানই ছিল বেশি। মাঠে সাবিনার দুর্দান্ত খেলা দেখে ওই বছরই জাতীয় দলে ডেকে নেন ফুটবল ফেডারেশনের কোচরা। ২০১০ ঢাকা এসএ গেমসের জন্য ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে আবাসিক ক্যাম্পে ওঠেন সাবিনা।

সাবিনা খাতুন। ছবি: ছুটির দিনে

ঘরোয়া ফুটবলে সাবিনা মুড়িমুড়কির মতো গোল করেন। এটা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। কখনো এক ম্যাচে একাই করেন ১৩ গোল! কখনো ১০টি! সাবিনাকে তাই ‘গোলমেশিন’ বলে চেনে সবাই। ২০১০ সাল থেকে টানা জাতীয় দলে খেলছেন। জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছেন চার বছর। এসএ গেমস, সাফ, এএফসির টুর্নামেন্ট ও প্রীতি ফুটবল মিলিয়ে ৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়েছে সাবিনার।

ফুটবলার না হলে কী হতেন? প্রশ্নটা করতেই সাবিনার সরল জবাব, ‘জানি না।’ বড় বোন চেয়েছিলেন লেখাপড়া শিখে যেন চিকিৎসক হন সাবিনা। কিন্তু ফুটবলের প্রতি সাবিনার টান এতই যে পড়ার টেবিলে সেভাবে মনই বসত না। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাবিনা। এলাকায় গেলে সাবিনার সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করেন সাবিনা, ‘বাড়িতে গেলে খুব বেশি বের হই না। কিন্তু বাজারে বা দোকানে গেলে সবাই আমাকে দেখে বলে, ওই যে আমাদের সাবিনা আসছে।’

সাবিনার প্রথম কোচ আকবর আলীকে এলাকার লোকজন প্রায়ই বলে, মেয়েদের ফুটবল খেলা শিখিয়ে কী লাভ? আকবর আলীর উত্তর, ‘কিছু পাওয়ার আশায় ওদের ফুটবল শেখাই না। সাবিনা যখন দেশের বাইরে খেলে, তৃপ্তিতে বুক ভরে ওঠে।’

ফুটবল খেলার সুবাদেই সাবিনাকে এখন দেশ-বিদেশ ঘুরতে হয় প্রতিনিয়ত। দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরতে পেরে ভীষণ গর্বিত সাবিনা, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমার এমন একটা জীবন হবে কখনোই ভাবিনি। এমন সুযোগ খুব কম মানুষেরই আসে। যখন দেশের বাইরে খেলতে যাই, জাতীয় পতাকা বুকে থাকে। মাঠে জাতীয় সংগীত বাজলে তখনকার অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। আরেকটা ব্যাপার খুব ভালো লাগে। যখন হোটেল থেকে মাঠে বা অন্য কোথাও আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, সামনে-পেছনে ভিআইপি এসকর্ট থাকে। বাংলাদেশি হিসেবে তখন গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়।’

এখনো কোনো সাফ জেতা হয়নি জাতীয় মহিলা দলের। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা মাথার ওপর তুলে ধরতে চান সাবিনা, ‘একদিন সালাউদ্দিন স্যারের (বাফুফে সভাপতি) হাতে সাফ শিরোপা তুলে দেব, এমন স্বপ্ন দেখি।’

ফুটবল খেলার পাশাপাশি কোচিংটাও সেরে রেখেছেন। এএফসির ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স শেষ। ‘বি’ লাইসেন্সের পরীক্ষা দিয়েছেন। সাবিনা বলেন, ‘আমার পুরো ভাবনাজুড়ে ফুটবল। ফুটবলই আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।’

লেখক: সাংবাদিক