Thank you for trying Sticky AMP!!

অলৌকিক বেঁচে ফেরা

ইউএস–বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ১২ মার্চ। নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন পাইলট, ক্রু, যাত্রীসহ ৫১ জন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ২০ জন, যাঁদের ৯ জন বাংলাদেশি। সেই বেঁচে ফেরাদের দলেই ছিলেন শাহরীন আহমেদশেখ রাশেদ রুবায়েত। দুঃসহ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা শোনালেন তাঁরা দুজন।
শেখ রাশেদ রুবায়েত

দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারিয়ে যখন সংজ্ঞা ফিরে পেলাম, বুঝলাম তখন আমি হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। ৪০ মিনিট আগে যখন জরুরি বিভাগে ছিলাম, তখনকার কথা মনে পড়ল। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। জানলাম, এর মধ্যে আমার এমআরআই আর সিটিস্ক্যান হয়েছে। জরুরি বিভাগে যে নেপালি চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়েছেন। তাঁর কাছেই জানালাম—আমার পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। মাথায় গুরুতর জখম। ফুসফুসেও আঘাত লেগেছে, সেখানে পানিও জমেছে কিছুটা। পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, হাড়ও ভেঙেছে।

তিনিই জানালেন, আমার বাসা থেকে তাঁর মোবাইল ফোনে অনেকবার কল এসেছে। আমার পরিবার তাঁর নম্বর পেল কোথায়? তার আগে জরুরি বিভাগে পৌঁছা অবধি সময়ের কথা বলি।

চাকা কি রানওয়ে ছুঁল?
উড়োজাহাজের চাকা রানওয়ে ছুঁয়েছিল কিনা মনে নেই। হঠাৎ আমার মাথাটা সজোরে গিয়ে লাগে সামনের সিটে। এরপর আর কিছু মনে নেই। প্রায় দুই মিনিট পর সংজ্ঞা ফিরে পেলাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঝুলন্ত অবস্থায়। পা ওপরে, মাথা নিচের দিকে। হাতটাও কোথায় যেন আটকে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতটা টেনে বের করার চেষ্টা করলাম। বের হলো ঠিকই, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। এদিক-সেদিক থেকে আমি শুধু ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ আর্তচিৎকার শুনছি।

আরও খানিকটা পর বুঝতে পারলাম, আমি আটকে আছি লাগেজ কম্পার্টমেন্টে। উড়োজাহাজের মেঝে ফেটে আমার সিটটা উল্টে নিম্নমুখী হয়েছে। সিটবেল্ট বাঁধা আমি নিচের দিকে ঝুলে আছি। বাইরে একটানা সাইরেনের শব্দ। আবারও ‘বাঁচাও, বাঁচাও’, ‘ওমা, মরে যাচ্ছি’, আর ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার। অন্ধকার বলে বুঝতে পারছিলাম না আগুন লাগার কিছুই।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে বেঁচে ফেরার অনুষ্ঠানগুলো আমি দেখি। সেসব দু–একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। বিধ্বস্ত বিমান থেকে বেঁচে ফেরার গল্প নিয়ে সিনেমার কথাও মাথায় এল। এই চিন্তা যেন আমাকে কিছুটা সহায়তা করল। অন্তত আত্মবিশ্বাস বাড়াতে। আমার মনে হতে থাকল, আমি বাঁচব। তখনো হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। পা ওপরে। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোনো শুরু হয়েছে। তবু আমার মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো বাঁচব। তাই আমি পা ছাড়িয়ে নেওয়ার কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে সিটবেল্ট খোলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম। যে করেই হোক ক্লান্ত যেন না হই, সে চেষ্টাই করছিলাম।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এমন সময় বুট জুতার শব্দ পেলাম। কেউ একজন হেঁটে গেল ওপর দিয়ে। আমি ‘হেল্প মি, হেল্প মি’ বলতে থাকলাম। একজন থামলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হলো। তারপর আবারও নিশ্চুপ।
প্রায় ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেল (মিনিটের হিসাবগুলো অনেক পরে আমি অনুমান করে বের করেছি)। এমন সময় দেখি আমার সামনের অংশ কাটতে শুরু করেছে। একসময় আলোর ঝলকানি এসে চোখে লাগল। বাইরে অনেককে দেখতে পেলাম।
উদ্ধারকর্মীরা আমাকে দড়ি দিয়ে টেনে বের করতে শুরু করল। পায়ে অসহনীয় ব্যথা অনুভব করলাম। আমি থামালাম। আমার পা কোথায় যেন আটকে আছে, সেটা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। এভাবেই একসময় আমাকে বের করে আনা হলো। অ্যাম্বুলেন্সে তুলে আমাকে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলো। আমি রক্তাক্ত। আমার প্যান্ট কাটা হলো। রক্ত পরিষ্কার করা হলো। একজন চিকিৎসক এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’ তিনি জানালেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়েছেন। চিকিৎসকের কাছেই আমি ফোন নিয়ে মায়ের কাছে কল করলাম। ২১ বছর হলো বাবা মারা গেছেন। মাকে আমি সেই ধাক্কা দিতে চাইনি। মাকে মিথ্যা বললাম। আমি বললাম, আমি নেপালে পৌঁছেছি। ভালো আছি। বিমানবন্দরে একটু ঝামেলা হয়েছে পরে কথা বলব। মায়ের সঙ্গে কথা বলেই জ্ঞান হারালাম। যখন সংজ্ঞা ফিরে পেলাম, তখন আমি আইসিইউতে। ফের সেই চিকিৎসকের সাক্ষাৎ। শুরুতে যা বললাম।

হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল
দুর্ঘটনা ঘটেছিল সোমবার। মঙ্গলবার আমার বোন পৌঁছাল। পরদিন সহকর্মীরা। তারপর স্ত্রী। আরও অনেকেই এলেন খোঁজখবর নিতে। ছয় দিন আমি নেপালের আইসিইউতে ছিলাম। এরপর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হলো। আমার পাশের কেবিনে ছিলেন শাহিন বেপারি (পরে মারা যান)। কয়েক ধাপের সেই চিকিৎসা এখনো চলছে। যেতে হয়েছে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে। এখনো সেই চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যাচ্ছি। কিছুদিন পর আরেকটি অস্ত্রোপচার করাতে হবে।

লেখক: ব্যাংকার