Thank you for trying Sticky AMP!!

অসুখ

হাসপাতাল আমার সবচেয়ে অপছন্দের জায়গা, হাসপাতালের চারদেয়ালে কষ্ট আর কষ্ট। ওখানে রাত-দিন মৃত্যুদূত ঘুরে বেড়ায় কখন কাকে বধ করা যায় সেই ধান্দায়। সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি, যখন মনে হবে তোমার সৌরভের সময় শেষ, তখন টুপ করে নিয়ে যেয়ো—তা-ও ভালো, তবু টেনেটুনে হাসপাতালে এনে ফেলো না।
আমার মনের কথা সবার আগে টেলিপ্যাথি হয়ে বন্ধু আরিফের কানে পৌঁছে গেল। ফোন দিয়ে বলল, ‘সৌরভ রে, এক্ষুনি সিটি হাসপাতালে আয়, রাখছি...।’
এই না হলে কপাল!
অনেকের ডাক ফেরানো যায়, বন্ধুর ডাক অবহেলা করা যায় না, গেলাম ছুটে।
আরিফকে হাসপাতালের রিসিপশনেই পেলাম। মনমরা আরিফকে এই প্রথম দেখছি। ওর বাবার বাইপাস। মনে মনে ওর বাবার জন্য প্রার্থনা শুরু করে দিলাম।
রাত ১২টার আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় এলাম। পরদিন খুব সকালে হাসপাতালে এসে বসে আছি। আরিফ
আমাকে দেখে বলল, ‘কী রে, এত আগে এসে বসে আছিস?’
আন্তরিকতা নিয়ে বললাম, ‘তোর বাবা তো আমারও বাবা।’
আরিফ আর কিছু বলল না। বলি, ‘তুই আঙ্কেলের কাছে যা, আমি ছিলাম এতক্ষণ।’ ও চলে গেলে আমি রিসিপশনের সামনের সারির একটি চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসলাম।
আরিফের বাবা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন দুই দিন হলো। তবু আমি এই হাসপাতালে সতেরোবারের মতো এলাম আজ। নিজেরও কয়েকটা রুটিন টেস্ট করা উচিত। একজন পরিচিত ডাক্তারের কাছ থেকে সবগুলো টেস্ট লিখিয়ে নিয়ে এসেছি। ইদানীং তাজা তাজা মানুষ মরে যাচ্ছে, আগে থেকে টেস্টটোস্ট করালে নাকি অকালমৃত্যু ঠেকানো যায়। রিসিপশনে আলাপ করতেই বড় অঙ্কের একটা হিসাব দিল ওরা। শেষে মুখে মেঘ জমিয়ে বলি, ‘আজ তো সব টেস্ট করার মতো টাকা নেই, আজ শুধু একটা, সম্ভব না?’
রিসিপশনের মেয়েটি হেসে বলল, ‘অবশ্যই সম্ভব স্যার।’
-থ্যাঙ্কু, আমাকে স্যার বলবেন না। ভাইটাই বলতে পারেন, আবার সৌরভও বলতে পারেন।
-সরি?
-জি সৌরভ।
-সরি স্যার, এখানে অন্য কিছু বলার নিয়ম নেই।
মেয়েটি মুখে হাসি ধরে বলল। আমিও পাল্টা হাসি ফিরিয়ে দিলাম ভদ্রতার খাতিরে।
পরদিন রিপোর্ট আনতে বিকেল পাঁচটার দিকে চলে এলাম। মেয়েটি বলল, ‘গতকাল আপনাকে বলা হয়েছে, সন্ধ্যা সাতটার পর রিপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হবে। রিপোর্টেও লেখা আছে দেখুন।’ তারপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘এরা কেন যে সামান্য ব্যাপারেও ভুল করে।’
-সরি, সমস্যা নেই, অপেক্ষা করব আমি।
মেয়েটি আমার কথা শুনতে পেল না, একটা ফোন কল রিসিভ করে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি সামনে পাতা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলাম অসুস্থ মানুষের মতো।
পরদিন আবার এলাম। দ্বিতীয় টেস্ট। পরদিন বিকেল পাঁচটায় গেলাম রিপোর্ট আনতে, এবারও ভুল; রিপোর্ট দেবে সন্ধ্যা সাতটায়।
পরপর ছয় দিন এভাবে চলল। রিসিপশনের মেয়েটিও এখন আমাকে চিনে গেছে, আমিও তার নাম জানি, ওর নাম ‘অমি’। অমির সামনে গেলেই বলে, প্রতিদিনই আপনার একই ভুল হয়।
আমিও উদাস হয়ে বলি, ভুলে ভুলে জীবনটা শেষ। আবারও অমি মেয়েটি হাসি দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একে একে মানবদেহের সব টেস্ট ওখানে করা হয়ে গেছে। তবু একদিন চোখে-মুখে ভয় ফুটিয়ে অমির কাছে জানতে চাইলাম, আর কী টেস্ট আছে দেখেন না?
-আমাদের এখানে আর কেনো টেস্ট নেই, অন্য কোথায় দেখতে পারেন।
-নেই?
-আপনি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী টেস্ট করাননি?
-তাই তো করিয়েছি...
-ডাক্তার কী বলছে?
-কোনো রোগই নেই...
-ওমা তাহলে তো ভালো, শুধু শুধু এত চিন্তা করছেন আপনি!
-না না, একটা অসুখ নিশ্চয়ই হয়েছে...
-ডাক্তারকে বলেন...
-হুম বলতে হবে...
এরপর আর কথা চলে না, সেদিনের মতো চলে আসি।
পরদিন অমির সাপ্তাহিক ছুটি। আমার আর যাওয়া হয় না। পরের দুই দিনও গেলাম না জরুরি একটা ব্যস্ততায়। তৃতীয় দিন দুপুরের প্রথম ভাগে চলে আসি হাসপাতালে।
অমি নেই। ওর জায়গায় অন্য একজন বসে আছে। জানতে চাইলাম অমির কথা।
বলল, ‘ওর বিয়ে। ছুটি নিয়েছে।’
বুঝলাম, এর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। চলে আসি।
পরদিন। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামার আয়োজন চলছে। ভিজলাম মনের সুখে। কাকভেজা হয়ে অমির ওখানে গেলাম। অমি আপন মনে কাজ করছে। আমাকে দেখে প্রথমটায় চিনতে পারেনি। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘আপনি?’ সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল অমি।
-জি, আমার একটা কঠিন অসুখ করেছে, আপনাদের এখানে ভর্তি হতে এলাম।
-ওমা তাই নাকি! কই দিন দেখি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন।
-ডাক্তারগুলো সব ফালতু, ঠিকঠাক রোগ ধরতে পারে নাকি!
-তাহলে? অমির চোখ দুটি নেচে উঠল যেন।
-আমার অসুখের নাম অমি!
মাসুম বিল্লাহ