Thank you for trying Sticky AMP!!

আড্ডা না হলে আমার চলে না: অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
নোবেল পুরস্কার বাঙালিকে আরেকবার গৌরবান্বিত করল। সবাই জানেন, এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন ‘বাঙালি বাবু’ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ভারতের মুম্বাইয়ে, ১৯৬১ সালে। এখন অবশ্য মার্কিন নাগরিক। অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনাও করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। বেড়ে উঠেছেন কলকাতায়। আবদুল লতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাবের সহপ্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ। নোবেলজয়ে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন তাঁর ফরাসি বংশোদ্ভূত মার্কিন স্ত্রী এস্তার দুফলো এবং আরেক মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্রেমারকে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস জানিয়েছে, বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য তাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া তাঁর পুরোনো দুটি সাক্ষাৎকার নতুন করে ছেপেছে। সেখানে উঠে এসেছে তাঁর পড়াশোনা, দেশের পরিস্থিতি ও ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়–আশয়।


আমি প্রথমে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে (আইএসআই) ভর্তি হয়েছিলাম। কয়েকটি ক্লাস করার পর কোর্সটি আমার কাছে সাক্ষাৎ আতঙ্ক মনে হলো। শেষমেশ ইস্তফা দেব বলেই মনস্থির করলাম। তারপর প্রশ্ন এল, আমি কী করব? গণিতে বেশ ভালোই ছিলাম। ফলে আইএসআইয়ে যে আমার জায়গা হবে, এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম। এ কারণে আর কোথাও পরীক্ষাও দিইনি।

আমার মা–বাবা দুজনই অর্থনীতির শিক্ষক, তবে তাঁরা কখনো আমাকে অর্থনীতিতে পড়ার কথা সরাসরি বলেননি। মনে পড়ে, বাবা আমাকে এমন একটা বিষয় বেছে নিতে বলেছিলেন, যেখানে গণিতটা কাজে লাগে। সে ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা ছিল জুতসই এক বিকল্প। কিন্তু আমি তা বেছে নিইনি। কেননা, আমি জানতাম, পদার্থবিদ্যা ভালোবাসে এমন অনেকেই বিষয়টি বেছে নেবে। আমার ওতে তেমন আগ্রহও ছিল না। পরিচিত অনেককেই দেখেছি, যাঁদের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আগ্রহ ছিল না বলে অর্থনীতি বেছে নিয়েছিলেন। শেষতক একই ঘটনা ঘটেছিল আমার বেলাতেও।

শিক্ষাবিদের দায়িত্ব

দুনিয়াটা কীভাবে চলে, এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ মানুষ—উভয়েরই একাধিক তত্ত্ব আছে। আমার বিশ্বাস, একটিমাত্র বিষয় শিক্ষাবিদদের আলাদা করে তোলে। সেটি হলো, তাঁরা চান দুনিয়া সম্পর্কে জানা তত্ত্বগুলো যতটা সম্ভব আত্মস্থ করতে। অর্থাৎ তত্ত্বগুলো যেন নিজের ভেতরেই সুসংহত হয়। পৃথিবীর দিকে যখন তাকাই তখন মনে হয়, এটা নিয়ে আমার একটি তত্ত্ব আছে, ওটা নিয়ে আমার একটি তত্ত্ব আছে। প্রশ্ন হলো, এই তত্ত্বগুলো একত্র করে আরও গুছিয়ে আনার ব্যাপারে কতটা কাজ করলাম। আমি মনে করি, একজন শিক্ষাবিদ পৃথিবীকে সুশৃঙ্খল করতে সব সময় মিতব্যয়ী কিছু তত্ত্ব খোঁজার চেষ্টা করে। এ কথা সমাজবিজ্ঞানীদের বেলায় বেশি প্রযোজ্য। আমার মনে হয়, এ কারণেই আমি সব সময় কোনো একটি বিষয় নিয়ে একাধিকবার ভাবি। ধরা যাক, নির্দিষ্ট একটি প্রস্তাব আমি দিয়ে দিলাম। এবং তারপর দেখা গেল, সেটি আর কাজ করছে না। ঠিক তখনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের প্রশ্ন করে, এটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে আর কী কী ঠিক নয়? এটাই হলো শিক্ষাবিদদের শক্তি। এই শিক্ষা আমাদের কখনোই ‘আচ্ছা, বেশ, ভালোই তো…’ বলে কাজ শেষ করার অনুমতি দেয় না। আমরা সব সময় আরও দূরে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন অনুভব করি।

যেখানে গলদ

আমাদের দেশে সরকারি এমন অনেক প্রকল্প আছে, যেগুলো আদতে কোনো কাজেরই নয়। কেন? কারণ, আমরা সেগুলোর নকশাই করি যেনতেনভাবে। আমাদের আরও অর্থ ব্যয় করা উচিত কি না, এ নিয়েও তো আমরা মাঝেমধ্যে তর্ক জুড়ে দিই। কিন্তু তর্ক তো হওয়া উচিত অর্থ ব্যয়ের সবচেয়ে ভালো উপায় কী হবে, তা নিয়ে। আমরা যদি অর্থ ব্যয়ের সবচেয়ে ভালো উপায় নিয়ে চিন্তা করি, তবেই না সবচেয়ে ভালো ফলটি পাব। আমার শঙ্কা হয়, কারণ, সত্যিকার অর্থে কোনো কান্ডারি তো আমি দেখি না। কান্ডারির মতো কিছু আছে বটে, তবে তা মোটেও কান্ডারি নয়। যা আছে তার সবই নামকাওয়াস্তে। আমরা জানি, অগোছালো পরিকল্পনার প্রকল্পগুলো কাজ করবে না, তারপরও আমরা তা শুরু করে দিই। কেউ চায় না যে একটু থেমে ওগুলোর ভালোমন্দ বিচার করা হোক।

আমি মনে করি, প্রকল্প পরিকল্পনাতেই বেশি তৎপর হওয়া জরুরি। তিন, চার অথবা পাঁচটি বিকল্প পরিকল্পনা করা হোক। তারপর দেখা যাক, কোনটা কাজ করে আর কোনটা করে না। কোনো প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার পেছনে রাজনৈতিক চাপ তো থাকেই, তবে এতে আখেরে কোনো সুফল মিলবে না। তেমন প্রকল্পেই আমাদের হাত দেওয়া উচিত, যার বিষয়বস্তু বাস্তব এবং যা সফল করা সম্ভব। বেশি আশাবাদী চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বেশি মনোযোগ দিতে হবে প্রকল্পের ব্যাপারে জনগণের প্রতিক্রিয়ার ওপর। আমরা কেমন প্রতিক্রিয়া চাই, তা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। আমাদের প্রকল্পগুলো ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কোনো রহস্য নেই। আমরা সেগুলোর নকশা নিয়ে মাথা খাটাই না বলেই সেগুলো ব্যর্থ হয়। তাই একটি কথাই বলতে চাই, প্রতিটি প্রকল্প সুন্দর করে নকশা করুন।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য মহৎ হতে পারে, তবে তাতে কিছুই যায়–আসে না। একটি প্রকল্পে একাধিক মহৎ উদ্দেশ্য থাকলে শেষমেশ কোনোটিই সফল করা যায় না। তাই আমাদের এমন একটি লক্ষ্যই বেছে নিতে হবে, যা অর্জন করা সম্ভব। একটি প্রকল্প হাতে নিন, সত্যিকার অর্থে সফল করুন, তারপর আরেকটিতে হাত দিন।

রান্না ও আড্ডা

আমি নিজেকে পাকা রাঁধুনি হিসেবেই বিবেচনা করি। রোজ কিছু না কিছু রাঁধি। ছেলেবেলা থেকেই রান্নাবাটিতে আমার আগ্রহ। এর পেছনে আমাদের বাড়ির পরিবেশের একটা হাত আছে বলে মনে হয়। এমন এক পরিবেশে আমি বেড়ে উঠেছি, যেখানে আমার মাসি–পিসিরা সারাক্ষণ খাবার নিয়েই কথা বলতেন। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও আমার মা নানান পদের রান্নার চেষ্টা করতেন। এবং মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সবচেয়ে মোক্ষম উপায় ছিল রান্নার সময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা। এটা–সেটা করে আমি তাঁকে রান্নায় সাহায্য করতাম। অভ্যাসটা রয়ে গেছে। আমি মাংসাশী। ফলে বলতে গেলে সবই খাই এবং রাঁধতেও চেষ্টা করি। বাঙালি খাবার প্রচণ্ড ভালোবাসি। সপ্তাহে কমপক্ষে দু–তিন দিন পাতে বাঙালি খাবার না উঠলে আমার চলে না।

আরেকটি জিনিস না হলে আমার চলে না। সেটি হলো আড্ডা। আমি বোধ হয় আমার আশপাশের মানুষদের চেয়ে একটু বেশিই আড্ডাবাজ। এটাও হয়তো হয়েছে ওই আমার বাড়ির পরিবেশের কারণে। ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে সবাইকে চুটিয়ে আড্ডা দিতে দেখেছি। আমাদের বাড়িতে আড্ডা দেওয়ার লোভে রোজ সন্ধ্যায় লোকের ভিড় লেগে যেত।

প্রিয় বাঙালি

দুজনের নাম বলতে চাই, যাঁদের আমি ভক্তি করি। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, যাঁকে আমি ব্যবহারিক পরিসংখ্যানের পথিকৃৎ বলে মানি। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন। তাঁর দর্শন ছিল অসাধারণ। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের মতো বিশ্বমানের এক প্রতিষ্ঠান।

আরেকজন প্রিয় বাঙালি হলেন বুদ্ধদেব বসু। বিপুল প্রজ্ঞা ও প্রভাব বিস্তারকারী মানুষ ছিলেন তিনি। লেখক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। বৃহৎ পরিসীমায় কিছু দেখার চোখ ছিল তাঁর। বুদ্ধদেব বসু মানুষকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহী করে গেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন তুলনামূলক ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। 

অনুবাদ: মাহফুজ রহমান, সূত্র: টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া