Thank you for trying Sticky AMP!!

আম্মা আমার প্রাণশক্তি

মা ও মেয়ে—নার্গিস মালেক ও মালিহা মালেক কাদির। ছবি: প্রথম আলো
>

আগামীকাল মা দিবস। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, উদ্যোক্তা মালিহা মালেক কাদির। 

১৯৯৬ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজে সবে স্নাতকে ভর্তি হয়েছি। থাকতাম ডরমিটরিতে। থাকা নিয়ে সমস্যা হলো না, কিন্তু খাওয়াদাওয়া নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়লাম। বাঙালি খাবার না খেলে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হতো; ভাত-মাছ ছাড়া একেকটা দিন ভাবা যায়! ভেতো বাঙালি শব্দটাই এ ক্ষেত্রে জুতসই বলে মনে হলো—আমার অবস্থা তখন ঠিক তেমন। সে সময় মুখিয়ে থাকতাম আম্মার পথ চেয়ে। তিনি কখন আসেন। আম্মা আমাকে দেখতে আসতেন দুই সপ্তাহ পর পর। সঙ্গে রেঁধে আনতেন নানা পদের খাবার। দু-এক দিন থেকে আবার তিনি চলে যেতেন নিউইয়র্কে। তখন কী যে আনন্দ হতো বলে বোঝানো যাবে না।

এ ঘটনা বলার কারণ আমার খাবার নিয়ে নয়। কারণটা, আম্মা। আমার কষ্ট হবে ভেবে বছরের অর্ধেকটা সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন, আর এদিকে আব্বা হয়তো তখন দেশে ব্যবসা সামলাচ্ছেন। তাঁর দিক থেকে নিঃসন্দেহে এটা বড় ত্যাগ স্বীকার। তবে তাঁর এই ত্যাগের শুরুটা আরও আগে। আমার বয়স তখন ১৪ বছর। পড়াশোনা ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু আম্মা ভাবলেন আমাকে তাঁর আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন। সেই সময় তিনি জীবন বীমা করপোরেশনের উচ্চ পদে চাকরি করেন, সরকারি সে চাকরি থেকে নিলেন ইস্তফা।

‘ও’ লেভেল পরীক্ষার আগের কথা মনে পড়ে—আম্মার তখন একটাই কাজ, আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে তিন-চারজন শিক্ষকের বাসায় পড়তে নিয়ে যাওয়া, বাসায় ফিরে আবার পড়ানো। অনেক সময় দাওয়াত-পার্টিতে যাননি শুধু আমার পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে। একসময় ভাবি, আমি হয়তো আমার সন্তানদের জন্য এতটুকু করতে পারব না।

তবে আম্মার প্রতি মুগ্ধতা ছোটবেলার। তিনিই আমার বড় অনুপ্রেরণা। বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় দেখতাম, নানাবাড়ি-দাদুবাড়ির সবাই আসছেন আম্মার কাছে। পরিবারের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আম্মার মতামত নেওয়া হচ্ছে; তাঁর কথার গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আম্মা তো বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানতেন, তাই তিনি সঠিক পরামর্শ নিতে পারতেন। আব্বাও সব সময় আম্মার সঙ্গে তাঁর কাজের ব্যাপারগুলো ভাগাভাগি করতেন। আরও বড় হতে হতে জেনেছি আম্মার পরিশ্রমী জীবনের কথা। আম্মা যখন কলেজে পড়তেন, তখনই আমার নানু মারা যান। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। তাই ঘরের সব দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। এক হাতে তিনি সব সামলাতেন। এত কিছুর পরও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পাঠ শেষ করেছেন, চাকরি করেছেন। এখন বুঝি—একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে এবং অনায়াসে দায়িত্ব গ্রহণে আম্মার এই ব্যাপারগুলো আমাকে কতটুকু সহায়তা করেছে। যেমন সহায়তা করেছে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া কঠোর পরিশ্রম করার শিক্ষাটা, আর একজন সফল নারী হিসেবে পত্রিকায় প্রকাশিত আম্মার সাক্ষাৎকার, সেগুলোও আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করত।

আম্মা সব সময় বলতেন, ‘মানুষকে কখনো ছোট করবে না’, ‘দম্ভ দেখাবে না’। আর চালাকি-চতুরতা করে কিছু না করার শিক্ষা আব্বা-আম্মা দুজনের কাছ থেকেই পেয়েছি। এই সৎ শিক্ষা আমি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেনে চলি। আমার কাজের মধ্যেও এই বিষয়গুলোর বড় প্রভাব রয়েছে। শুধু নিজের কাজেই নয়, আমি চেষ্টা করি আমার সন্তানদেরও এই শিক্ষায় বড় করতে।

আম্মার আরেকটা বিষয় আমাকে সব সময় অবাক করে, তিনি কারও বদনাম করতে পারেন না। মাঝেমধ্যে ভাবি, একটা মানুষ কারও বদনাম না করে দিনের পর দিন কীভাবে চলতে পারেন! একটা সময় দেশের বাইরে থাকতাম। সে সময়টায় এখানকার অনেক কথাই আমি জানতাম না। আম্মার সঙ্গে কথা হলে তিনি সেসব বলতেন না। বলতেন না কারণ, মানুষের সমালোচনা হবে বা কূটনামি হয়ে যাবে এই ভেবে! এটা তাঁর স্বভাবজাত। এই গুণ খুব কম মানুষের মধ্যেই আমি দেখেছি।

এখন অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়, তবু সব কাজের ফাঁকে আম্মার খোঁজ নেওয়া আমার রুটিনের অংশ। আর এখনো কোনো সংকটে পড়লে, কোনো একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে, আম্মার কাছে যাই, তাঁর পরামর্শ নিই। সত্যি বলতে, আম্মার পাশে গিয়ে বসতেই যেন আমি পূর্ণ প্রাণশক্তি ফিরে পাই; আর সেই প্রাণশক্তি নিয়েই তো কাটছে দিন।

প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সহজ ডটকম