Thank you for trying Sticky AMP!!

আর চাই না ডেঙ্গু

জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে । মডেল: জলি ও আয়ান, ছবি: সুমন ইউসুফ
>এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু এবার নগরবাসীকে ভয়াল আতঙ্কে গ্রাস করে নিয়েছে। এরই মধ্যে আক্রান্ত কিংবা এখনো আক্রান্ত হয়নি—সবাই রয়েছে আতঙ্কে। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ, আক্রান্ত হলে করণীয়, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ আয়োজন। 

কামুর প্লেগের মতো ডেঙ্গু এবার রাজধানী ঢাকাকে ভয়াল আতঙ্কে গ্রাস করে নিচ্ছে। বাড়িতে, অফিসে, স্কুলে, যানবাহনে—সর্বত্র ডেঙ্গু নিয়ে আলোচনা। যে বাড়িতে ডেঙ্গু হানা দিয়েছে তাদের অবস্থা তো অবর্ণনীয়ই, যেখানে এখনো হানা দেয়নি, তাঁরাও রয়েছেন আতঙ্কে। শুধু ঢাকা নয়, এবার দেশের বেশিরভাগ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। 

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হিসাব অনুযায়ী গেল সপ্তাহ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৩ হাজারের মতো রোগী। এই সংখ্যা বিগত বছরগুলোর মধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে বেশ কটি অমূল্য প্রাণ। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, চিকিৎসক, শিশু–কিশোরসহ রয়েছেন অনেকে। 

ডেঙ্গু, এডিস মশা ও নিরুপায় মানুষ

ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রথম প্রাদুর্ভাব ২০০০ সালে। সে বছরই প্রথম এডিস এজিপ্টি নামের মশাটির নাম শুনেছিল ঢাকাবাসী। প্রথম বছর আনুমানিক ৫ হাজার রোগী আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা শহরে; মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। এর দুই বছর পর ২০০২ সালে ৬ হাজার ২০০ জন আক্রান্ত হয় ডেঙ্গুতে। মারা যায় ৫৮ জন। তারপর প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর–অক্টোবর) যেন নিয়ম করে ঢাকাবাসী নাকাল হচ্ছে এই এডিস মশার হাতে। গত বছর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা–এর মতো এসে হাজির হয়েছিল নতুন রোগ—চিকুনগুনিয়া। অথচ এত রোগ শোকের পরও এডিস মশা ও ডেঙ্গু ভাইরাস দমনে আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে আমরা সবই ভুলে যাই সময় পেরিয়ে গেলে।

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। চার ধরনের সেরোটাইপ আছে এই ভাইরাসের। একেকবার একেক ধরনের ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ হয়। এই ভাইরাস ছড়ায় বিশেষ প্রজাতির এডিস মশার মাধ্যমে। মশার কামড়ে ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভাইরাস দেহে বংশবৃদ্ধি করে রোগের সূচনা করে। তারপর এই রোগ মোট তিনটি পর্যায় বা ফেজে অতিবাহিত হয়। ফেব্রাইল, ক্রিটিক্যাল ও রিকভারি বা কনভালেসেন্ট ফেজ। এডিস মশা শহরাঞ্চলের আবদ্ধ জলাধার বা পানিতে বংশ বিস্তার করে। যেমন টবের পানি, নারকেলের মালা, এসির নিচে জমে থাকা পানি ইত্যাদি। ঘরবাড়িতে লুকিয়ে থাকে পর্দার পেছনে, খাট বা টেবিলের তলায়, থাকে গাড়িতে, সিটের নিচে। শীত ও শুষ্ক মৌসুমে এক বছরের মতো সময় এই মশার ডিম টিকে থাকতে পারে এবং বর্ষা আসামাত্র পানির সংস্পর্শে এসে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষকে কামড়ানোর মাধ্যমে নারী এডিস মশা প্রথমে জীবাণুবাহক হয় এবং তারপর সে অন্য কাউকে কামড়ালে মশার লালার মাধ্যমে সেই ব্যক্তিও আক্রান্ত হয়। এভাবেই চক্রবৃদ্ধি হারে ছড়াতে থাকে আশপাশে। 

ডেঙ্গু থেকে তাই সাবধান

চিকিৎসকেরা বলছেন, এই মৌসুমে সর্দি কাশি বা গলাব্যথা ছাড়া যেকোনো জ্বরকে তাই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বরের কিছু নির্দিষ্ট উপসর্গ আছে, কিন্তু সব সময় সবার যে সব উপসর্গ মিলে যাবে, তা–ও নয়। তাই জ্বর হলেই সাবধান। সাধারণত ডেঙ্গু শুরু হয় আকস্মিক জ্বর নিয়ে, তার সঙ্গে থাকতে পারে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখব্যথা, আলোতে অস্বস্তি, কোমরে বা পেছনে মেরুদণ্ডে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যথা। এ ছাড়া অরুচি, বমি ভাব, কখনো শরীরের ত্বকে লাল লাল র​্যাশ। এ প্রসঙ্গে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেদওয়ানুর রহমান বলেন, শুরুতেই কিছু উপসর্গ ডেঙ্গুর তীব্রতার মাত্রাকে নির্দেশ করতে পারে। যেমন বারবার বমি, তীব্র পেটব্যথা, প্রচণ্ড দুর্বলতা, অস্থিরতা ইত্যাদি। ডেঙ্গুর জ্বর বা ফেব্রাইল ফেজ সাধারণত থাকে ৫ থেকে ৭ দিন, তারপর জ্বর ছেড়ে যায় কিন্তু এ সময়ই জটিলতার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কেননা এ সময় ক্রিটিক্যাল ফেজ শুরু হয়। রক্তনালির প্লাজমা বা তরল বাইরে বেরিয়ে আসা (প্লাজমা লিকেজ) আর রক্তচাপ কমে যাওয়া হলো মূল জটিলতা। ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মতো থাকে এই ক্রিটিক্যাল ফেজ। এই সময় রোগীকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। হাত–পা শীতল হয়ে আসা, চিকন ঘাম, রক্তচাপ কমে যাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, অস্থিরতা, উল্টাপাল্টা আচরণ, শ্বাসকষ্ট, পেট বা ফুসফুসে পানি জমা ইত্যাদি সমস্যা এ সময়ই হয়ে থাকে। কোনো কোনো রোগীর ত্বকের নিচে, নাক, মাড়ি, চোখের কনজাংটিভায় রক্তপাত হতে পারে, কালো পায়খানা হতে পারে, রক্তবমি বা মাসিকের রাস্তায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। কেউ কেউ শকে চলে যেতে পারে। রক্তচাপ কমে গিয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে মাল্টি–অরগান ফেইলিউর হতে পারে। এগুলোই মৃত্যুর কারণ। তবে মোট ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে সামান্যসংখ্যক রোগীই এ ধরনের জটিলতায় প্রাণ হারায়। বেশির ভাগই ক্রিটিক্যাল ফেজ কাটিয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে সেরে যায়। তাই অধ্যাপক রেদওয়ানের মতে, প্যানিক বা আতঙ্ক নয়, আমাদের চাই সতর্কতা। ডেঙ্গুর ঘটনাক্রম ও বিপদচিহ্নগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা ভালো।

হাসপাতালগুলোতে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

এ সময় বাড়িতে কারও জ্বর হলে তাই সম্ভব হলে প্রথম বা দ্বিতীয় দিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে ফেলা ভালো। রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট আর ডেঙ্গু এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন। জ্বরের ৪ দিনের মধ্যে এই অ্যান্টিজেন টেস্ট করে ফেলা ভালো, এরপর তা নেগেটিভ হয়ে যায়। তবে এরপর আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট ও অন্যান্য পরীক্ষার ভিত্তিতে রোগ নির্ণয় করা যাবে। সরকার এই এনএসওয়ান পরীক্ষার মূল্য ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, কোথাও কোথাও এর চেয়ে কম মূল্যেও হচ্ছে। তাই দেরি না করে পরীক্ষাটা করে ফেলা ভালো। যদি ডেঙ্গু এনএসওয়ান পজিটিভ হয়, তবে তা নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এমন নয়। বাড়িতে রোগীর যত্ন নিন। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকবেন, টয়লেটে যাওয়া বা খাবার টেবিল অবধি হাঁটাহাঁটির মধ্যেই চলাফেরা সীমাবদ্ধ রাখুন। ভ্রমণ বা বাইরের কাজ করবেন না। যথেষ্ট তরলজাতীয় খাবার ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। একজন বয়স্ক ব্যক্তি সারা দিনে ৩ লিটার বা ১২ গ্লাসের মতো তরল খেলেই চলবে। পানি ছাড়াও ডাবের পানি, ফলের রস, জুস ইত্যাদি খেতে পারেন। যদিও অরুচি হয়, তবু চেষ্টা করুন অল্প অল্প করে সারা দিনে ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতে। শর্করা খাওয়া ভালো, কেননা এ থেকে প্রচুর এনার্জি পাবেন। ডেঙ্গু রোগীকে বাড়িতে মশারির মধ্যে রাখুন। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দিন। জ্বর সেরে যাওয়ার পর থেকে রোগীকে সারাক্ষণ মনিটরিং করুন। চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন কী কী হলে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। এই বিপদচিহ্নগুলোর কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া বাড়িতে রক্তচাপ ও নাড়িস্পন্দন দেখুন বা নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। ডেঙ্গু হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে এক লাখের নিচে চলে যায়, কিন্তু এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডেঙ্গুতে বিশ্রাম, যথেষ্ট তরল, প্রয়োজনে সতর্কতার সঙ্গে শিরায় স্যালাইনই মূল চিকিৎসা—আর কিছু নয়। জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন, চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখুন। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, হৃদ্​রোগী, কিডনি রোগী, বয়স্ক অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সতর্কতা দরকার, প্রয়োজনে হাসপাতালে রেখে মনিটরিং করা উচিত। 

ডেঙ্গু আর কাম্য নয়

ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার পর প্রতিবছর এটি হয়ে ওঠে নগরবাসীর অন্যতম আলোচ্য বিষয়। টেলিভিশন, পত্রপত্রিকায় আবদ্ধ পানি পরিষ্কার, ঘরবাড়ির পরিচ্ছন্নতার দিকে বারবার নজর দিতে বলা হতে থাকে। তারপর যে কে সেই। আবার আবর্জনার স্তূপ আর খোঁড়াখুঁড়ির শহরে ড্রেন, লেক, রাস্তার ধারে পানি জমে, পানি জমে নির্মাণাধীন দালানে, দুই দালানের মাঝের সরু প্যাসেজে জমে থাকে এসির পানি, ছাদে, টবের নিচে, টায়ারে—কোথায় নেই? এত যে মৃত্যু, এত যে ভোগান্তি, তারপরও না সিটি করপোরেশনের, না টনক নড়ে ঢাকাবাসীর। এই ফাঁকে এডিস মশা শহর দখল করে নেওয়ার পাঁয়তারা করতে থাকে। 

অথচ একটু সচেতন হলেই আমরা এই রোগকে প্রতিরোধ করতে পারতাম। বাড়ি এবং এর চারপাশ পরিচ্ছন্ন, আবর্জনামুক্ত ও আবদ্ধ পানিমুক্ত রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের মতো নাগরিকদেরও। প্রয়োজনে নিজস্ব বহুতল ভবনে বা পাড়ায় বা গলিতে দলবদ্ধভাবে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালু করা যায়। অফিস–আদালতে বিশেষ কার্যক্রম নেওয়া যায়। স্কুল বা কোচিংয়ের অভিভাবক শিক্ষক এককাট্টা হয়ে কাজ করতে পারেন। প্লাস্টিক আর আবর্জনা ফেলে শহরের পানিনিষ্কাশনব্যবস্থাকে আমরাই তো ধ্বংস করেছি। তাই ডেঙ্গুর বিস্তারের দায় আমাদেরও কম নয়। ধনী–দরিদ্র, ছোট–বড়নির্বিশেষে যেকোনো মানুষেরই ডেঙ্গু হতে পারে। এ শহরের প্রাণঘাতী মশককুল তো কাউকেই ছেড়ে কথা বলবে না। তাই সচেতনতা শুরু হোক আজই, নিজের বাড়ি থেকে। 

লেখক: চিকিৎসক