Thank you for trying Sticky AMP!!

আলোয় ভরা সাকরাইন

সাকরাইন উৎসবে রঙিন আলোর ঝলকানি। ছবি: সুমন ইউসুফ

সারা দিন যে আকাশে ঘুড়ি উড়েছে, সন্ধ্যা নামতেই সে আকাশ ভরে উঠল আলোর ঝলকানিতে। রংবেরঙের আলো, আতশবাজির সঙ্গে তাল মেলাচ্ছিল রঙিন লেজার রশ্মি। বেজেছে নানা রকম গান। সুর আর আলোয় পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার তখন উৎসবের নগর। যদিও অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো সব সুর মিলেমিশে রূপ নিয়েছে একক এক সুরে, অর্থ না–বোঝা এই সুরকে বরং বলা যায় উৎসবের সুর! এই আলোক উৎসব সাকরাইনের অন্য রূপ।

পৌষসংক্রান্তির উৎসব সাকরাইন। সাধারণত এক দিনের আয়োজন হলেও পুরান ঢাকায় এবার দুই দিন ধরে এ উৎসব চলে। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, পান্নিটোলা, রাঁধিকা মোহন বসাক লেন, ঝুলনবাড়িতে সাকরাইন উদ্‌যাপিত হয়েছে ১৪ জানুয়ারি। আর লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুরের একাংশ, গেন্ডারিয়া, ধূপখোলা, যাত্রাবাড়ীর মানুষ উৎসবে মেতেছে ১৫ জানুয়ারি।

তরুণেরা মেতে ওঠেন গানের সুরে

শাঁখারীবাজারে উৎসব লেগেছিল সাকরাইনের অনেক আগেই। ঘুড়ি বিক্রির দোকানগুলোতে উঠেছিল রংবেরঙের ঘুড়ি। ১৪ তারিখের আয়োজন ছিল ভিন্ন রকম। খাবারের দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয় বাতাসা, সন্দেশ, মুড়ির মোয়া। দিনভর বাজানো হয় গান।

শাঁখারীবাজারের পান্নিটোলার এক বাড়ির ছাদে যাওয়ার সুযোগ হলো। ছোট-বড় মিলে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত সবাই। আকাশে তখন উড়ছিল লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি রঙের ঘুড়ি। ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নাটাই হাতে নিজের ঘুড়ি সামলাতে বেশ ব্যস্ত একেকজন। তবে আরেক দল ব্যস্ত ডিজে পার্টির মঞ্চ সাজাতে। বাড়ির কর্তা পলিন দেব বললেন, ‘সাকরাইনের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই কাঁচা হলুদ দিয়ে গোসল করে। এরপর ছাদে এসে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হয়। এটাই রীতি।’

হিন্দুধর্মের মানুষের জন্য দিনটি অবশ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পৌষসংক্রান্তিতে শাঁখারীবাজারের মন্দিরগুলোতে আয়োজন করা হয় পূজার। অনেকের কাছে যেটি ‘বুড়ো-বুড়ি’ পূজা নামেও পরিচিত। পূজা উপলক্ষে সারা দিন উপোস করেন পুরান ঢাকার হিন্দুধর্মাবলম্বীর লোকেরা।

সাকরাইনের প্রধান অকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো। ছবি: সাবিনা ইয়াসমীন

আকাশে যে উৎসব, সেটি ঘুড়ি ওড়ানোর। এটি পরিচিত সাকরাইন নামে। পৌষকে বিদায় জানাতে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে এই উৎসব উদ্‌যাপন করেন পুরান ঢাকাবাসী। চলে এক বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা। নবাবি আমলে খোলা মাঠে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও এখন ঘুড়ি ওড়ানো হয় বাড়ির ছাদ থেকে। নানা রঙের বিচিত্র আকারের ঘুড়িতে যেন রঙিন হয়ে ওঠে পুরান ঢাকার আকাশ।

পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসবের শুরুটা হলফ করে বলা মুশকিল। তবে ঐতিহাসিকেরা বলেন, সতেরো শতকের নবাবি আমল থেকে পুরান ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের শুরু। সে সময় উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন নবাবেরা। পুরান ঢাকাবাসীর কাছে এ উৎসব হাকরাইন নামেও পরিচিত। [সূত্র: ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী—মুনতাসীর মামুন ও বাংলাদেশের উৎসব—খোন্দকার রিয়াজুল হক]

১৫ জানুয়ারির উৎসবে রাত আটটার দিকে লক্ষ্মীবাজারে যাওয়া। সেখানে গিয়ে যে আলোক উৎসব পাওয়া গেল, সেটাই-বা কম কিসে! দু-এক বাড়ি পরপরই আয়োজন। ছাদ থেকে ভেসে আসছে আতশবাজির শব্দ। তাতে শুধু যে পুরান ঢাকার অধিবাসীরা উৎসবে শামিল হয়েছেন, এমন নয়। এসেছেন সারা ঢাকা থেকেই। তাঁদের কেউ অতিথি, কেউবা কৌতূহলী দর্শক।

সাকরাইনের প্রধান অকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো। ছবি: সাবিনা ইয়াসমীন

লক্ষ্মীবাজারে ব্যবসায়ী আদনান আহমেদ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে সাকরাইন আয়োজন করেছেন। বললেন, ‘আয়োজনটা হয় এলাকাভিত্তিক। বন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলি। সে টাকায় ঘুড়ি, আতশবাজি কেনা হয়। করা হয় আলোকসজ্জা।’

অন্যদের চেয়ে কতটা সুন্দর আর জমকালো করা যায়, তার এক নীরব প্রতিযোগিতা থাকে আয়োজকদের মধ্যে। আদনানের অতিথি হয়েই এক বাসার ছাদে যাওয়ার সুযোগ হলো। গানে মেতে থাকা তরুণ দল তখন আতশবাজি ফোটাতে ব্যস্ত। কথা হলো কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদেরই একজন খায়রুন নাহার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী লক্ষ্মীবাজারেই থাকেন। পুরান ঢাকার মানুষ নন, তবে উৎসবে অংশ নিতে আগ্রহের কমতি ছিল না তাঁর। মাসখানেক আগেই ঘুড়ি আর আতশবাজি কিনে রেখেছেন। কার বাসায় অতিথি হওয়া যায়, তারও ব্যবস্থা করেছেন।

সাকরাইন উৎসব এক বা দুই দিনের। কিন্তু আয়োজনের রেশ থাকে আরও বেশ কিছুদিন। সেসব নিয়েই গলির মোড়ের দোকানগুলোতে কথা চালাচালি হয় তরুণদের। আদনান বললেন, ‘এটাই বোধ হয় সাকরাইনের বড় আনন্দ।’