Thank you for trying Sticky AMP!!

ইয়ুথ এজি সামিট ২০১৯: কৃষি-ভাবনায় কৃতিত্ব

ইয়ুথ এজি সামিটে অংশ নেওয়া বিভিন্ন দেশের তরুণেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইয়ুথ এজি সামিট হলো কৃষিপ্রযুক্তিবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ২০১৩ সাল থেকে দুই বছর পরপর এই আয়োজন করে আসছে জার্মানভিত্তিক জীববিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘বায়ার’। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও টেকসই পদ্ধতিতে কৃষি খাতের উন্নয়নের আইডিয়া বা ভাবনা নিয়ে এই সম্মেলনে যোগ দেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের তরুণেরা। এ বছর ইয়ুথ এজি সামিট ২০১৯-এ বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন সাদমান ফয়সাল ও কাজী জাওয়াদ হোসেন। 

ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া শহরে গত ৩ থেকে ৭ নভেম্বর সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অংশ নিয়েছিলেন ৪৫টি দেশের ১০০ জন। এর মধ্যে জাওয়াদ ও সাদমান, দুজনই ছিলেন চূড়ান্ত পর্বের সেরা ১২ জনের মধ্যে। আর শেষ পর্যন্ত সেরা ৩-এ স্থান করে নিয়েছেন সাদমান। 

সাদমানের ‘সতেজ ট্যাগ’

বিভিন্ন সবজি, ফলমূল উৎপাদনের পর ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর আগেই বেশ কিছু অংশ পচে যায়। এর অন্যতম কারণ হলো উৎপাদিত সবজি-ফলমূল কত দিন সতেজ থাকবে, সেটি উৎপাদনকারীরা সঠিকভাবে জানেন না। আন্দাজের ওপর নির্ভর করেই পণ্য বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। ফলে রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায় অনেক সবজি-ফল। 

সাদমানের পরিকল্পিত ‘সতেজ ট্যাগ’ এই সমস্যার সমাধানে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘সতেজ ট্যাগ’ ছোট্ট একটি যন্ত্র। একটা টমেটো কত দিন পর্যন্ত সতেজ থাকবে, সেটা সহজেই বলে দিতে পারবে এই যন্ত্র। যন্ত্রে আছে তাপমাত্রার সেন্সর, এলইডি ইন্ডিকেটর ও একটি ডিসপ্লে। তাপমাত্রা পরিমাপ করে যন্ত্রটি ডিসপ্লেতে দেখিয়ে দেবে, টমেটোর সতেজতার আয়ুকাল কত দিন। 

বাঁ থেকে জাওয়াদ ও সাদমান

২০১৮ সাল থেকে ‘সতেজ ট্যাগ’ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন সাদমান। এই প্রকল্পে সাদমানের সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু জুবায়ের হোসেন, মোহাইমেন হোসেন, শারার বিন রহমান ও আফনান আহমেদ। গত বছরের ডিসেম্বরে ইয়ুথ এজি সামিটে নিবন্ধন করেন সাদমান। এরপর চলতি বছরের মে মাসে জানতে পারেন, সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি মনোনীত হয়েছেন।

এর আগেও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন সাদমান ফয়সাল। তবে তাঁর কাছে এই সম্মেলনের অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম ছিল বলে মনে করেন তিনি। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। সেসব দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনেছেন অনেক কিছু। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের জানাতেও ভুল করেননি।

পাঁচ দিনের এই সম্মেলনে একাধিক দলগত আলোচনা আর প্রেজেন্টেশনে অংশ নিতে হয়েছে। সবার নজর কেড়েছিল তাঁর আইডিয়া। আর তাই তো চূড়ান্ত পর্বে সতেজ ট্যাগের গায়ে লেগে গেল ‘বিজয়ীর ট্যাগ’। সাদমানের আত্মবিশ্বাস ছিল ভালো কিছু একটা করবেন। তবে বিজয়ী বনে যাবেন, এত দূর পর্যন্ত ভাবেননি তিনি। আয়তনে ছোট একটি দেশের প্রতিনিধি বলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেই কিছুটা হেলার চোখেও দেখেছিলেন। কথায় নয়, কাজেই মেধার প্রমাণ দিয়েছেন সাদমান।

সাদমান বলেন, ‘বাংলাদেশকে অনেকেই চেনে না, তাই শুরুতে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না। তবে বিজয়ী হওয়ার পর সবাই এসে পিঠ চাপড়ে আমাকে শুভকামনা জানিয়েছে।’ 

বিজয়ী হিসেবে সাদমান পেয়েছেন পাঁচ হাজার ইউরো (প্রায় ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা)। প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে শিগগিরই পাইলট প্রকল্প শুরু করতে চান তিনি। ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি যন্ত্র তৈরি করেছেন। এর সঙ্গে আরও কিছু যন্ত্র তৈরি করে কৃষকদের কাছে বিতরণ করতে চান। এ প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন হলে বাণিজ্যিকভাবে কাজ শুরু করার কথা ভাবছেন তিনি।

সাদমান এখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মরত আছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে। ভবিষ্যতেও উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে চান এই তরুণ। 

জাওয়াদের জিও পটেটো 

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফসল আলু। তবে আলু চাষে সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম ‘লেট ব্লাইট’ রোগ। এই রোগ দমনে কৃষকদের মোবাইলে আগাম তথ্য দিচ্ছে জিও পটেটো প্রকল্প। এই প্রকল্পের স্থানীয় সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত আছেন কাজী জাওয়াদ হোসেন। 

২০১৮ সাল থেকে এমপাওয়ার সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজেস আর নেদারল্যান্ডসের ওয়াখানিগেন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এই প্রকল্প চালু করেছে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন জাওয়াদ। এর কিছুদিন পরই যোগ দেন প্রকল্পে। 

স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেসিং ও আবহাওয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলুর ছত্রাকজনিত লেট ব্লাইট রোগ আগাম শনাক্ত করতে পারে জিও পটেটো সার্ভিস। এ ক্ষেত্রে কৃষককে একটি হটলাইন নম্বরে ফোন করে আলু চাষের নির্ধারিত মাস ও চাষাবাদ এলাকা (উপজেলা ও জেলা) জানাতে হয়। এরপর তথ্য বিশ্লেষণ করে ফসলের বৃদ্ধির ধাপ অনুযায়ী কৃষকদের এসএমএস ও ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে করণীয় জানিয়ে দেওয়া হয়। প্রকল্পটির অধীন মুন্সিগঞ্জ, রংপুর ও দিনাজপুরের প্রায় ৪২ হাজার কৃষক তাঁদের সেবা নিয়েছেন। 

জাওয়াদ জানালেন, তাঁদের এই সেবার মাধ্যমে অনেক কৃষক উপকৃত হচ্ছেন। তাঁরা সঠিক সময়ে পরিমিত পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমছে। আবার কৃষকদেরও কীটনাশকের পেছনে খরচ কমছে। 

জিও পটেটো প্রকল্পটি নিয়ে ব্রাজিলের ইয়ুথ এজি সামিটে গিয়েছিলেন জাওয়াদ। কার্যকরি এই প্রকল্প ছিল চূড়ান্ত পর্বে মনোনীত ১২টি আইডিয়ার মধ্যে একটি। বিজয়ী হতে না পারলেও আফসোস নেই জাওয়াদের। চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত যেতে পেরেই দারুণ উচ্ছ্বসিত তিনি। জাওয়াদ বলেন, অনেকেই হয়তো ভাবেননি বাংলাদেশ এত ভালো করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্বে একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরই সর্বোচ্চ দুজন প্রতিনিধি ছিলেন। এই ব্যাপারটিই তাঁকে গর্বিত করেছে। 

সফরে বিভিন্ন দেশের কৃষি, সংস্কৃতি, খাবার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন জাওয়াদ। ঘুরে দেখেছেন ব্রাজিলের কৃষিব্যবস্থা। শুধু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে ব্রাজিলের কৃষি খাত যেভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, দেখে মুগ্ধ হয়েছেন জাওয়াদ। সম্মেলন থেকে অর্জিত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা নিজেদের প্রকল্পে কাজে লাগানোর শতভাগ চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।