Thank you for trying Sticky AMP!!

উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা কম

পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রধান রুবিনা ফেরদৌসি অভিযানে দায়িত্ব পালন করছেন। ছবি: পরিবেশ অধিদপ্তরের সৌজন্যে

দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থায় জ্যেষ্ঠ সচিব থেকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী কর্মকর্তারা কাজ করলেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এই যোগ্য নারী কর্মকর্তারা অনুপস্থিত। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের শীর্ষ নেতৃত্বেও এর আগে কোনো নারী কর্মকর্তাকে আনা হয়নি। তবে নারীদের দায়িত্ব দিলে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়, তার ফলাফলও দৃশ্যমান হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থায় পরিবেশ রক্ষায় বরাবরই নারী নেতৃত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। 

এক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব পেয়েছেন রুবিনা ফেরদৌসি।

রুবিনা ফেরদৌসি বলেন, ‘বড় বড় অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে নিজে উপস্থিত থাকি। এ চেয়ারে প্রথমবারের মতো একজন নারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই আমি সব সময় চেষ্টা করি, কেউ যেন বলতে না পারে এ চেয়ারে একজন পুরুষ থাকলে আরও ভালো কাজ করতেন।’

রুবিনা ফেরদৌসি আরও বললেন, এখানে যাঁদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়, তাঁরা সমাজে প্রভাবশালী। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কাজ করাটা অনেক চ্যালেঞ্জের। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নারীরা থাকলে পরিবেশ নিয়ে ব্যবসা করা দালাল বা প্রভাবশালী মালিকেরা নারীদের কাছে তেমন একটা ঘেঁষতে পারেন না, যত সহজে পুরুষের কাছে ঘেঁষতে পারেন। ফলে, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং পরিবেশ রক্ষায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রুবিনা ফেরদৌসি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত এক বছরে পরিবেশের ক্ষতি করছে—এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ধরার অভিযান ও জরিমানার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। গত বছরের ১৫ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় জরিমানা ধার্য ও আদায়ের পরিমাণ সাত কোটি টাকা, যা এর আগের বছরের তুলনায় বেশি। 

১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ জন কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনও নারী নেই। সংস্থাটির ২৮ বছরের ইতিহাসে মাত্র এ বছরই একসঙ্গে দুজন নারী কর্মকর্তা পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন। আর দুজন রয়েছেন উপপরিচালকের দায়িত্বে। সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মোট ২২ জন কর্মকর্তার মধ্যে সাকল্যে চারজন হচ্ছেন নারী। সারা দেশে সংস্থাটির ৬৪ জন কর্মকর্তার মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ছয়, অর্থাৎ ১০ শতাংশেরও কম।

 জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, সারা দেশে সরকারি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৭ শতাংশ। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরে এই সংখ্যা ১০ শতাংশের কম। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত আরেক সংস্থা বন অধিদপ্তরে মোট ১১০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে মাত্র ১১ জন নারী, এখানে তবু ১০ শতাংশ! সংস্থাটির প্রধান হিসেবে ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৫ জন প্রধান বন সংরক্ষকের দায়িত্ব পালন করলেও কোনো নারীকে এখন পর্যন্ত এ পদে দেখা যায়নি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় আরেকটি ট্রাস্টি সংস্থা হলো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট। সরকারের জলবায়ু তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে এই সংস্থা। ২০১০ সালে গঠিত ওই সংস্থার প্রধান হিসেবেও এখন পর্যন্ত কোনো নারী কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। বর্তমানে এখানে ২১ জন কর্মকর্তা আছেন, যার মধ্যে নারী মাত্র তিনজন।

সরকারি-বেসরকারি নানা গবেষণায় দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত তিনটি প্রকল্প পেয়েছে, যেখানে নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও টিকে থাকার ব্যাপারে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্প পেয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার ব্যাপারে সহায়তা দেওয়া। দেশের সবচেয়ে বেশি লবণাক্ত পানির ওই এলাকার নারীদের সুপেয় পানির সরবরাহ করা প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু এসব কাজে নারী কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ দেখা যায় না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ১৩৩ জনের মধ্যে নারী কর্মকর্তা আছেন মাত্র সাতজন। সংস্থাটির মহাপরিচালক থেকে শুরু করে প্রথম ১৩ জন শীর্ষ কর্মকর্তাই পুরুষ। সংস্থাটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে—এমন পাঁচটি আইন রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, নীতিমালা থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টারসহ (এসওডি) সব আইন ও বিধিমালায় নারী খুব বেশি গুরুত্ব পাননি।

দেশের পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে নারীরা নেতৃত্বে আছেন। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন সুলতানা কামাল। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে রয়েছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ভূমির অধিকার ও পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করির প্রধান নির্বাহী হলেন খুশী কবির। এ ছাড়া আছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধূরী ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণদানকারী বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম। পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশভিত্তিক সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ। তারা এখন বিশ্বের ছয়টি দেশে কাজ করছে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হচ্ছেন রুনা খান। এ ছাড়া পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ব্রতীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন শারমিন মুর্শিদ। র‍্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার পাওয়া অ্যাঞ্জেলা গোমেজসহ দেশের শতাধিক নারী বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রধান নির্বাহী ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন।

সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নারীদের যোগাযোগ অনেক বেশি। পরিবেশে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তার ক্ষতিকারক প্রভাবের শিকার সবচেয়ে বেশি হন নারীই। এ কারণে সামগ্রিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষা পেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এমন ধারণা সরকারি সংস্থাগুলো করলেও তা ঠিক না। পরিবেশ সুরক্ষার কাজেও নারীকে যুক্ত করলে বাড়তি ফল পাওয়া যাবে। যেমন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সেখানকার মানুষের পরিবারের জন্য অনেক দূর থেকে মিঠাপানি সংগ্রহ করতে হয়। এ কারণে নদীগুলোয় মিঠাপানি বাড়লে, নদী দূষণমুক্ত হলে নারীদের কষ্ট কমে। তাই পরিবেশ সুরক্ষার সরকারি নেতৃত্বে নারীদের আরও বেশি সুযোগ দেওয়া উচিত। 

আন্তর্জাতিক সংস্থা একশনএইড, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, পরিবেশ সুরক্ষায় তৃণমূলে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনেও নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কৃষি গবেষণায়ও নারীরা আসছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লে পরিবেশ রক্ষার কাজ সঠিকভাবে এগোবে। কেননা, নারীরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকলে ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়।