Thank you for trying Sticky AMP!!

এই মস্কো, সেই মস্কো

মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা অনুষদ

আমি মস্কো ছেড়েছি ১৯৮০ সালের মে মাসে, আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। সেই শহর তখন ছিল হারিয়ে যাওয়া দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী। এরপর সেই দেশটিতে আর যাইনি। যদিও স্মৃতির পাতায় আজও অম্লান আমার সাত বছরের মস্কোজীবনের নানা অধ্যায়। সেই স্মৃতির খানিকটা আমি তুলে আনার চেষ্টা করেছি স্মৃতিচারণামূলক বই আমার প্রবাস জীবন: সোভিয়েত পর্ব–তে। গত বছরের মাঝামাঝি বইটি প্রকাশিত হয়েছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে।

মস্কোর স্মৃতিকথাটি লিখে শেষ করার আগে ওই শহরে আমি এ কারণে যেতে চাইনি যে আমার আশঙ্কা ছিল এই শহরকে ঘিরে মধুর যেসব স্মৃতি রয়েছে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তা হয়তো কিছুটা হলেও রং হারিয়ে ফেলতে পারে। ফলে আমার যৌবনের ফেলে আসা শহরে আবারও যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মনের গভীরে সযত্নে ধরে রেখেছিলাম সেই বাসনা। তো বইটি প্রকাশের পর মস্কো ঘোরার ইচ্ছা আবার পাখা মেলল।

গেল সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি যাত্রা করেছিলাম মস্কোর উদ্দেশে। ভেবেছিলাম আমার মনের মধ্যে যে মস্কো ধরা আছে, নানা রকম রদবদলের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ বিরতির পর সেখানে গিয়ে তা হয়তো পাব না।

আমি পড়ালেখা করেছি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে। সেই অনুষদটি মস্কোর নগরকেন্দ্রেই অবস্থিত। এবারের ভ্রমণে মস্কো পৌঁছে প্রথম রাতেই বের হয়েছিলাম নগরকেন্দ্রের আগের পরিচিত সেই জায়গাগুলো দেখে নিতে। হোটেল থেকে হেঁটে অল্প সময়ে আমরা চলে আসি রেড স্কয়ারে, ক্রেমলিনের সামনে। খেয়াল করলাম, ক্রেমলিন রয়ে গেছে আগের মতোই। যদিওমূল অট্টালিকার মাথায় শোভা পাচ্ছে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকা নয়, বরং নবীন রাশিয়ার তিন রঙের ঝান্ডা। রঙিন সাজে সজ্জিত সেন্ট বাসিল গির্জার ওপর এসে পড়া উজ্জ্বল আলো গির্জাকে করে তুলছে অনেক বর্ণাঢ্য। তুলনায় ক্রেমলিনের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লেনিনের সমাধি যেন পড়ে আছে পাড়ার দরিদ্র প্রতিবেশীর বসতভিটার মতো।শুধু তা-ই নয়, এখন রেড স্কয়ারের চারদিকজুড়েই প্রচারিত হচ্ছে ধর্মের জয়জয়কার।

ইতিহাস জাদুঘরের ঠিক পাশে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে কাজান গির্জা; আশপাশের ভবনের যেসব দেয়ালে চার দশক আগে শোভা পেতে দেখেছি কাস্তে-হাতুড়ি, দেয়ালের সেই সব অংশ এখন চলে গেছে সনাতন রুশ খ্রিষ্টধর্মের সন্তদের দখলে। আলোকিত ক্রেমলিন এবং আলোর বন্যায় ভেসে থাকা রেড স্কয়ারকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত দেখালেও কোথায় যেন রয়ে গেছে মস্ত ফাঁক। এক ইতিহাসকে ধরে রেখে অন্য ইতিহাসকে অস্বীকার করে যাওয়ার প্রচেষ্টাই হয়তো সেই ফাঁকটুকু আমার মতো একসময় ওই শহরে বসবাস করা মানুষের চোখে পড়বে সহজেই।

সেন্ট বাসিল ক্যাথেড্রাল, যা মস্কোর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গির্জা

পরদিন গিয়েছিলাম আমার বিদ্যাপীঠ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা অনুষদে। এটি একসময় ছিল মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবন। হালকা হলুদ রঙের ওই ভবনের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনের পর্দায় একে একে ভিড় করতে থাকল পুরোনো অনেক স্মৃতি। ভবনের সামনে আগের মতো এখনো আছে মিখাইল লমনোসোভের দণ্ডায়মান মূর্তি। এর চারপাশের ছোট উদ্যানটিতে ছড়ানো-ছিটানো কয়েকটি বেঞ্চে আমাদের সময়ের মতোই বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা। এসব দেখতে দেখতে আমি ডুবে গেছি স্মৃতির গহিনে, মনে মনে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমার সেই সময়ের বন্ধুদের। একসময় ওই বন্ধুদের মুখগুলোই যেন অজ্ঞাতে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ভবনের দরজার সামনে। কিন্তু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বাস্তবতার আঘাতে আমাকে ফিরে আসতে হলো ৪০ বছর পরের এই সময়ে। দরজার ঠিক সামনে বসানো মেটাল ডিটেক্টরের অন্য পাশ থেকে ভেসে আসা ভারী কণ্ঠস্বর আমাদের কাছে জানতে চায়, কোথায় যাচ্ছি আমরা? পুরোনো স্মৃতিঘেরা ভবনটি দেখতে এসেছি বলায় আবারও ওই ভারী কণ্ঠ যে কথাটি বলে তা হলো, অনুমতিপত্র আছে? তাকে বললাম, নেই। এবার ওই ভারী কণ্ঠস্বরের দ্বাররক্ষী স্রেফ জানিয়ে দিল যে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার নয়। তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে চার দশক আগে সেখানে লেখাপড়া শেষ করে সুদূর জাপান থেকে আমরা এসেছি স্মৃতিঘেরা এই ভবন শুধু একবার ঘুরে দেখার জন্য। তারপরও এল একই উত্তর। ফলে আমরা যখন অনেকটা হতোদ্যম হয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, সেই সময় আমার প্রায় সমবয়সী একজন পুরুষ আমাদের থামতে বলে দ্বাররক্ষীকে কিছু একটা বললেন। ব্যস, আমাদের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মিলে গেল। সেই ব্যক্তির নাম সম্ভবত সের্গেই ইভানভ। জানালেন এই ভবনের তত্ত্বাবধায়কের কাজ করেন তিনি। এত দূর থেকে এসে আমাদের ফিরে যেতে হচ্ছে দেখে তাঁর মনে হয়েছে, এটা ঠিক হচ্ছে না। তাই দ্বাররক্ষীকে বলে আমাদের ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

আমাদের সেই পরিত্রাতা সের্গেই ইভানভ এরপর প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে ভবনের বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটি বিভাগ ও শ্রেণিকক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের সামনে তিনি তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিকতা অনুষদের বর্তমান পরিচিতি। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আমাদের অতীতের সেই শিক্ষকদের কেউ এখন সেখানে কর্মরত আছেন কি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, পুরোনোদের মধ্যে একমাত্র সেই সময়ের ডিন ইয়াসিন জাসুর্স্কি এখনো সাংবাদিকতা অনুষদের সম্মানিত সভাপতির দায়িত্বে আছেন এবং সপ্তাহে দুই দিন তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন। জাসুর্স্কি যে এই বৃদ্ধ বয়সেও সক্রিয় আছেন শুনে আমি স্বস্তি বোধ করলাম। তবে যেদিন আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, সেদিন তাঁর অফিসে আসার কথা বিকেলের দিকে। ফলে আমাদের দেখা হয়নি ইয়াসিন জাসুর্স্কির সঙ্গে।

গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ দিকে যখন আমি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অধ্যয়নরত, জাসুর্স্কি তখন আমাদের পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের ওপর একটি ক্লাস নিতেন। বিজ্ঞাপন যে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমকে কীভাবে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, তার অনেক বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা আমরা নিয়মিতভাবে শুনেছি তাঁর কাছ থেকে। বিস্ময়কর হলো, এখন তিনি একই অনুষদের সম্মানিত সভাপতির পদে আসীন থাকা অবস্থায় এখানে নতুন যে কয়েকটি বিভাগ চালু হয়েছে, তার একটি হলো বিজ্ঞাপন ও জনসংযোগ বিভাগ। সের্গেই ইভানভ আমাদের সেই নতুন বিভাগেও নিয়ে গেলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনদাতাদের মহিমাকীর্তন এবং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ছাত্রদের শিক্ষিত ও জ্ঞাত করে তোলাই হচ্ছে এই বিভাগের দায়িত্ব। ফলে নতুন রাশিয়ার পরিবর্তন যে অনেক সুদূরপ্রসারী, তা অনুধাবনে আনতে বিশেষ কষ্ট হয়নি।

সের্গেই ইভানভের কাছে আরও জানতে চেয়েছিলাম আমাদের সময়ের মতো বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগসহ নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে বৃত্তি পাওয়ার ব্যবস্থা এখনো চালু আছে কি না। আমাকে তিনি বললেন, কেবল প্রতিভাবান রুশ ছাত্রদের বেলায় সেই ব্যবস্থা আজও কার্যকর আছে, তবে বিদেশিদের নিজ খরচেই লেখাপড়া করতে হয়। তাদের শুধু টিউশন ফি বাবদ যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তার পরিমাণ একেবারে কম নয়। তবে এরপরও সাংবাদিকতা অনুষদে বিদেশি ছাত্রের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশি, বললেন সের্গেই ইভানভ।

এই বিদেশি কারা? আমার
প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র আজকাল আসছে চীন থেকে। সন্দেহ নেই ভর্তির মাপকাঠি এখন বিত্তের ওপরে অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল।