Thank you for trying Sticky AMP!!

একটি আপাতত সফল আন্দোলনের গল্প

‘যে জাতি ভাড়াটেদের ছাদে যেতে দেয় না, সে জাতি কীভাবে চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে!’

কথাটা শুনে রুমমেট ছোট ভাই বলল, ‘একের কথা বলছেন ভাই। আপনাকে স্যালুট!’ ছোট ভাইয়ের স্যালুট পেয়ে খুশি হওয়ার কিছু নেই। সব কথাই ওর কাছে ‘একের কথা’ এবং ‘স্যালুট’ পাওয়ার যোগ্য। যদি বলা হয়, ‘খুব খিদা লাগছে, রান্না করা দরকার।’ ও উত্তর দেবে, ‘একের কথা বলছেন ভাই, আপনাকে স্যালুট!’

স্যালুটে মন ভরল না। বৃষ্টি নেমেছে, ছাদে গিয়ে ভেজার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু উপায় নেই। ব্যাচেলর হওয়ার পরও বাড়িওয়ালা যে ভাড়া দিয়েছেন, এই তো অনেক। বাঙালির সমস্যাই এটা—বসতে দিলে ছাদে উঠতে চায়! তারপরও আমরা ঠিক করলাম, ছাদে আমাদের যেতেই হবে। পুরো ঢাকা শহরে ব্যাচেলর ভাইয়েরা ছাদে যাওয়া থেকে বঞ্চিত। আর কত ব্যাচেলর এভাবে বন্দিজীবন কাটাবে? সুতরাং আন্দোলনের বিকল্প কিছু নেই। চাই দুর্বার আন্দোলন।

‘সারা বাংলা ঘেরাও দে, ব্যাচেলরদের খবর দে’ স্লোগান দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ব্যাচেলর ভাইদের সঙ্গে কথা বললাম। ফেসবুকে খুলে ফেললাম একটা গ্রুপ—‘দাবি মোদের একটাই, ছাদের গেটের চাবি চাই’। নিজেদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বেছে বেছে ব্যাচেলরদের অ্যাড করতে লাগলাম আমরা। দুই ঘণ্টার মধ্যে এক হাজার মেম্বার হলো গ্রুপে। এরপর শুরু হলো স্ট্যাটাসের নামে একের পর এক জ্বালাময়ী স্লোগান দেওয়ার পোস্ট।

লেখা হলো অমর কিছু স্লোগান, ‘ছাদের তালা ভাঙব, জগৎটাকে দেখব!’, ‘কেউ যাবে কেউ যাবে না, তা হবে না তা হবে না।’ ১২ ঘণ্টার মাথায় ৩০ হাজার মেম্বার হয়ে গেল গ্রুপে। বাংলার ব্যাচেলর-সমাজ আজ জেগে উঠেছে। এদের কোনোভাবেই থামানোর উপায় নেই।

এক ব্যাচেলর ভাই এক লাইন বেশি এগিয়ে। তিনি নিজ খরচে ডিজিটাল ব্যানার বানিয়ে আনলেন। রাজপথ আটকে আন্দোলন করতে চান। গ্রুপে ব্যানারের ছবি দেখে স্পিড মানি ছাড়াই সবার উৎসাহ বেড়ে গেল। ঠিক হলো, পরদিন বেলা ২টা থেকে রাজপথে চলবে আমাদের দুর্বার আন্দোলন।

যেই কথা সেই কাজ। ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক ব্যাচেলর আন্দোলনে চলে এল। রাজপথ লোকে লোকারণ্য। পুলিশ আপাতত ঝিম মেরে আছে। যেকোনো আন্দোলনের প্রথম দু-চার ঘণ্টা পুলিশ ঝিম মেরে থাকে। এই দু-তিন ঘণ্টায় প্রশাসন নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়, আন্দোলন বানচাল করা হবে, নাকি চলতে দেওয়া হবে। বানচালের সিদ্ধান্ত হলে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, জলকামান নিয়ে নেমে পড়বে। তবে আন্দোলন যেভাবে বড় হচ্ছে, তাতে পুলিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে। বরং কয়েকটা টিভি চ্যানেল এবং অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকেরা চলে আসছেন। আন্দোলনের খবর গুজবের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে।

যেকোনো ইস্যুতে বাঙালি খুব সহজে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ‘ছাদে যেতে চাই’ আন্দোলনও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বিপক্ষ দলে বাড়িওয়ালা এবং তঁাদের আত্মীয়স্বজন। তঁারাও একটা ব্যানার নিয়ে রাজপথের আশপাশ দিয়ে শোডাউন করতে লাগলেন। সাংবাদিকদের ডেকে ডেকে ক্যামেরায় মুখ দেখাতে লাগলেন। তঁাদের যুক্তি, ছাদ খুলে দিলেই ব্যাচেলররা সেখানে গিয়ে টাংকি মারে, রাতের বেলা পুটুরপুটুর করে প্রেম করে, এ ছাড়া নেশাও করে!

ক্যামেরার সামনে ভাড়াটেদের গণহারে নেশাখোর বলায় সাধারণ ব্যাচেলররা খেপে গেল। যিনি এই কথা বলেছেন, তাঁকে অতিসত্বর ক্ষমা চাইতে হবে, এটা হয়ে গেল আন্দোলনের নতুন ইস্যু।

অনেকটা এলোমেলো অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রথম দিনের অবস্থান কর্মসূচি শেষ হলো। রাত হয়ে গেছে। সবাইকে বাড়ি ফিরতে হবে। আমাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে আগামীকাল থেকে আরও বড় কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন চলবে। সবাই যখন যে যার বাসায় ফিরবে, তখন বাধল নতুন সমস্যা। কিছু ক্ষমতাবান বাড়িওয়ালার ছেলে ঢাকার আশপাশ থেকে গুন্ডা ভাড়া করে এনে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন গ্রুপে হামলা চালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রাজপথে সুবিধা করতে পারল না। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো। আমরা হাঁফ ছাড়লাম।

কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও বাড়ল। ব্যাচেলররা যে যার বাসায় ফিরে গেছে, রাত ১১টায় গেটও বন্ধ হয়ে গেছে। এমন সময় দেখি, গেটের আশপাশ দিয়ে বাড়িওয়ালার ছেলে আর তাদের ভাড়া করা গুন্ডারা হকিস্টিকসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে! ফেসবুকে ঢুকে দেখি, সবার বাসার সামনেই একই অবস্থা।

আতঙ্কে কাটছে রাত। এক বাসায় নাকি গুন্ডারা ভাড়াটেদের মারধরও করেছে। এক ব্যাচেলর ভাইকে মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে। এসব শুনে বেশ কিছু আন্দোলনকারী তাদের বাসার গেট টপকে রাতেই রাজপথে নেমেছে। পরে ভুক্তভোগীর বাসায় গিয়ে জানা গেল, হাত ভাঙেনি। মারামারির একপর্যায়ে জানালায় হাত লেগে একটু কেটে গেছে। কিন্তু তাতে কী! বাড়িওয়ালারা কেন ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে আক্রমণ করলেন? এর জবাব চাই আমরা। প্রতি মাসে গুনে গুনে ভাড়া দিই, মাগনা তো থাকি না। আমরা ভাড়া না থাকলে এই ফাঁকা বাসা নিয়ে বাড়িওয়ালা করবেনটা কী?

দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই রাজপথ অচল হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমাদের ১০ সদস্যের এক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে একটা বৈঠকে বসল। বৈঠক শেষে বাড়িওয়ালাদের সংগঠন থেকে জানানো হলো, ২০ দিন সময় চায় তারা। ছাদে উঠতে দেবে কি না, এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। শুনে আন্দোলনকারীরা আরও রেগে গেল। বাড়িওয়ালাদের আশ্বাসে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই আন্দোলন ছেড়ে গেল। বেশির ভাগই গেল না। তারা অবুঝ প্রেমিকের মতো ‘আজকের মধ্যেই হ্যাঁ-না’ উত্তর শুনতে চায়। না হলে সবাই বাসা ছাড়বে। দরকার হলে ফুটপাতে থাকবে তবু ভাড়া বাসার নামে ওই জেলখানায় আর কেউ ফিরে যাবে না।

দ্বিতীয় দফায় বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে মিটিং হলো। এবং বিকেলের মধ্যেই এল কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত। আজ থেকে আর কোনো তালা নয়। ছাদে তালা তো থাকবেই না, সঙ্গে বাসার মূল গেটেও কোনো তালা থাকবে না! সাংবাদিক ডেকে বাড়িওয়ালারা এই সিদ্ধান্ত জানালেন।

আমরা খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আন্দোলন করলাম ছাদের গেটের জন্য, সেটা তো দিলই, নিচের গেটও দিল! হায় হায়! এখন তাহলে ভাড়াটেদের নিরাপত্তার ঝুঁকি কে নেবে?

আন্দোলনকারীরা যখন এ রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি, তখন দেখি রাজপথে বিজয় মিছিল করছে একটা দল। মিছিলের একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাড়িওয়ালার ছেলেরা। যে ছেলেরা গতকাল গুন্ডা দিয়ে আমাদের জিম্মি করে রেখেছিল, তারাই আজ বিজয় মিছিল করছে! এমনকি সাংবাদিকদের ডেকে জানাল, তারা নাকি শুরু থেকেই এই আন্দোলনের পক্ষে ছিল। ভাড়াটেদের কষ্টের কথা ভেবেই তারা এই আন্দোলন শুরু করেছিল। মাইক্রোফোন পেয়ে এক বাড়িওয়ালার ছেলে বলল, ‘আমরা আগে ব্যাচেলর, পরে বাড়িওয়ালার ছেলে। তাই ব্যাচেলরদের চাওয়া পূরণ করতে আমরা শুরু থেকেই আমাদের বাবা, মামা, চাচাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করিয়েছি।’

দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির কথা শোনা গেলেও আন্দোলনের ক্রেডিট ডাকাতির কথা এই প্রথম শুনলাম! তবে ক্রেডিট পাই বা না পাই, ছাদ তো পেয়েছি! ছাদ পাওয়ার খুশিতে আমরা আপাতত ক্রেডিট না পাওয়ার দুঃখ ভোলার চেষ্টা করলাম।