Thank you for trying Sticky AMP!!

এরাই রুখে দেবে ধর্ষকদের

ধর্ষণ রুখতে করতে হবে জনপ্রতিরোধ। ছবি: সাইফুল ইসলাম

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে শিউরে উঠি। ধর্ষণ-নির্যাতনের একেকটা শিরোনাম যেন একেকটা চপেটাঘাত। ‘হজরত আলী আর তাঁর মেয়ের আত্মহত্যা’, ‘কারখানার ভেতরেও পোশাকশ্রমিক ধর্ষিত’, ‘রাস্তায় গণধর্ষণের শিকার পোশাকশ্রমিক’, ‘ক্যাডার দিয়ে ধরে নিয়ে মেয়েকে ধর্ষণের পরে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করা’, ‘পয়লা বৈশাখে নারী নিপীড়ন’, ‘তনু হত্যা’, ‘মা-মেয়েকে ধর্ষণ করে ভিডিও প্রচার’, ‘বাসে একজন নারীকে গণধর্ষণ’, ‘বগুড়ার ধুনটে ৫ বছরের শিশু ধর্ষণ’, ‘বনানীতে নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণ’...। এভাবে বলতে শুরু করলে শেষ হবে না। ধর্ষণ আর নির্যাতনের শিকার নারীর জায়গায় নিজেকে ভাবলে এবং ওই মুহূর্তগুলোর অনুভূতি কী হতে পারে ভাবলে আর সহ্যও হবে না। কিন্তু কেন এ রকম ঘটনা ঘটছে, কারা করছে, তাদের ক্ষমতার ভিত্তি কোথায়, তাদের কাছে কীভাবে নারী একজন মানুষ না হয়ে কেবল যৌন ভোগ্যপণ্য আর ধর্ষণের বস্তু হচ্ছে, সেই পর্যালোচনা ছাড়া এর প্রতিকারের পথ পাওয়া কঠিন হবে।

সন্দেহ নেই, দেশে নারীর পদচারণা বদলেছে। যেই বদল মনে সাহস জোগায়। আশা জাগে নারীর শিক্ষার হার বাড়ছে দেখে। যাদের বড় অংশই এখন এমএ/বিএ পাস করে কেবল ঘরের কোণে হেঁশেলে বসে নেই। সমাজের পদে পদে বিছানো নানা বাধাবিপত্তি বৈষম্যের মধ্য দিয়েই তারা নানা পেশায় যুক্ত হচ্ছে। ঘর-বাইরে দুই জায়গাতেই যোগ্যতা-দক্ষতার প্রমাণ দিতে হিমশিম আর বেসামাল দশায় আছে। এরাই কেউ দাবি তুলছে ডে কেয়ারের, যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার; সরব হচ্ছে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে নারীর সৃজনশীল বিকাশের প্রশ্নে। নাগরিক হিসেবে সমাজে নারীর সুযোগের সমতার ফারাক নিয়েও কোথাও কোথাও সাহসী তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এসব সাহসী খোরাকের পাশাপাশি সবচেয়ে সাহসী হই, যখন কান পেতে শুনি নতুন শ্রমশক্তিতে লাখো নারী শ্রমিকের পায়ের আওয়াজ। চোখ এড়ানোর সুযোগ নেই, কৃষিকাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়ও।

কিন্তু এসব আশাজাগানিয়া ঘটনার পাশে সাম্প্রতিক সময়ে যখন পত্রিকার পাতা খুললে শহর, গ্রাম, পোশাকশিল্প অঞ্চলে ভয়াবহ মাত্রায় নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন বৃদ্ধির খবর পড়ি, তখন সেই সাহস ক্রোধের জন্ম দেয়, যন্ত্রণার জন্ম দেয়। নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র-সরকারের ভূমিকা কী, তাই নিয়ে প্রশ্ন আর বিস্ময় জাগে। প্রশ্ন জাগে, নারীর নিরাপত্তাহীনতা কোন জায়গায় পৌঁছালে এই মাত্রায় ধর্ষণ-নির্যাতন চলতে পারে।

নারীর অগ্রযাত্রা নিয়ে নানা কথা খোদ সরকারমহলসহ বিভিন্ন দিক থেকেই শুনতে পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলের নেতা নারী, নারীর অগ্রযাত্রা ঠেকায় কে! তাহলে কেন নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায় রাষ্ট্র এড়ায়? কেন নারী নিরাপদ বোধ করতে পারে না তার গ্রামে, শহরে, পাড়ায়-মহল্লায় এমনকি তার নিজ কামরার ভেতরেও? নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে সমাজের কাছ থেকে প্রায়ই শুনতে হয় ‘ওই নারীর চরিত্র ভালো ছিল না’; ‘ভালো পোশাক পরা ছিল না’; ‘পুরুষদের পথভ্রষ্ট করা এদের কাজ’। এ ধরনের কথা যখন রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারাও বলেন, তখন আদতে ধর্ষকই রক্ষা পায়। এসব কথা শুনে নারীর লজ্জিত হওয়ার, অপমানিত বোধ করার, অসম্মানিত হওয়ার কিছু নেই। বরং ধর্ষক এবং যারা ধর্ষককে রক্ষা করে নারীকে অভিযুক্ত করে, তাদের লজ্জা হওয়া উচিত, তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া উচিত।

গত এক বছরে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের মাত্রা বেড়েছে। আর এসব খবর মিডিয়ার বদৌলতে আগের চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। নারীরা ঘরের বাইরে কাজে বেরোচ্ছে, বাসে উঠছে, অফিস-কারখানায় যাচ্ছে। পথে-ঘাটে কাজের জায়গায় এমনকি নিজের বাড়িতেও যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই নেই তাদের। নারীর ঘরের বাইরের কাজে যুক্ততা বৃদ্ধি, পোশাকশিল্পে ৪৪ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী নতুন শ্রমশক্তি হিসেবে জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়ার ফলে নির্যাতনের খবরও বাইরে আসছে। এসব কথা আর ফিসফিস করে বলে লুকিয়ে রাখারও সুযোগ নেই। নিজ বাড়িতে আপন আত্মীয়রাই যখন ধর্ষণ করে, তখন ঘর রক্ষার জন্য অনেকেই আগে চুপ থাকত,কিন্তু এখন সেখানেও মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছে নারীরা, যেটা এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধেরই একটা নতুন দিক।

নারীর ওপর ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্তদের বড় অংশই ক্ষমতাশালীদের ছত্রছায়ায় থাকে। উল্লিখিত অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। এই ক্ষমতার বলয় তাদের অনেককেই পার পাইয়ে দেয়। ফলে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষকদের সাহস আরও বাড়ে। আর বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীকে যেভাবে যৌন ভোগ্যপণ্য হিসেবে ক্রমাগত উপস্থাপন করে, সেটাও ধর্ষণের ক্ষেত্র তৈরিতেই ভূমিকা রাখে।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীদের নতুন করে প্রতিরোধবলয় গড়ে তোলা এই মুহূর্তের একটি জরুরি কাজ। ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের দেশজুড়ে এখনো নারী আন্দোলন যথেষ্ট মাত্রায় শক্তিশালী না হওয়ায় ধর্ষক ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা সাহস পাচ্ছে অব্যাহত নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার। নারী আন্দোলনকে নতুন করে সংগঠিত করা, নতুন চেতনার নারী; নতুন শ্রম শক্তির পদচারণাই এখন ভরসা। এই প্রতিরোধে পুরুষকেও যুক্ত করতে হবে। যুক্ত করতে হবে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। আর সবচেয়ে জরুরি পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলা।

এই ‘নতুন নারী’ ‘নতুন শ্রম শক্তি’ যে সমাজের চোখ রাঙানি আর অপপ্রচারে লজ্জিত না, নতজানু না, ভীত না, সেই নতুন নারীরাই ধর্ষণসহ নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে এই ভরসা। এরাই রুখে দেবে পাড়া-মহল্লার ধর্ষকদের, সেই জাগরণের অপেক্ষায় গোটা সমাজ। অপেক্ষায় নতুন নারী শক্তি ও আন্দোলনের উত্থানের।

লেখক: সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি; শিক্ষক, পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট