Thank you for trying Sticky AMP!!

কবিতা পড়ার নেশাটা ছাড়তে পারিনি

অপি করিম, অভিনেত্রী

নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা ভালোবাসতে শুরু করলাম। হাতের কাছে যে কবিতাই পেতাম, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতাম। দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, বিশেষ সংখ্যা, কবিতার বই—কিচ্ছু বাদ যেত না। এমনকি কাগজের ঠোঙায়ও যদি কোনো কবিতা থাকত, সেটাও আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। এমনই আগ্রহ আর আবেশ তৈরি হয়েছিল কবিতার প্রতি। সে সময় মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ, জয় গোস্বামীর কবিতা খুব ভালো লাগত। এখনো সেই ভালো লাগা আছে।
কবিতার প্রেমে পড়ার আগেই আমি অবশ্য অন্যান্য বই পড়তে শুরু করেছিলাম। তাও মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে! আমার বাবার একটা ছাপাখানা ছিল, এখনো আছে। সেখানে অসংখ্য বই ছাপা হতো। সেই সুবাদেই আমার বই পড়ার শুরু। আমার জীবনের প্রথম পড়া বই বেগম মমতাজ হোসেনের সোনামনিদের পড়া।
বাবার একটা পাঠাগারও ছিল। ছিল দুই পাল্লার দরজাওয়ালা আলমারি। বাবা ছোটদের গল্প, রূপকথা, ছবি আঁকার বইগুলো আলমারির ভেতরে দরজার পাশেই রাখতেন, যেন আমরা ছোটরা হাতের নাগালেই এগুলো পাই। সেই সুযোগে পড়েছি অনেক বই।
সাহিত্য পড়তে শুরু করেছিলাম আরেকটু বড় হয়ে। বয়স তখন ১২ কি ১৩! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প তখন পড়া হয়ে গেছে। আবার একই সঙ্গে শার্লক হোমস, তিন গোয়েন্দাও পড়েছি। কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম, আমি সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার ভক্ত হয়ে গেছি! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগেই প্রিয় লেখকের তালিকায় যোগ হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত আলী আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু হতেই ধীরে ধীরে সাহিত্য পড়ার সুযোগটা কমে এল। তার বদলে পাঠ্যবই পড়তে শুরু করলাম। আসলে এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না।
জীবনের বিভিন্ন সময়ে, যে কাজই করি না কেন, বই পড়াটা কখনো ছাড়িনি। যেমন, অভিনয় করতে গিয়ে পড়তে হয়েছে। আবার এখন শিক্ষকতা করছি, এখনো প্রতিনিয়তই নতুন নতুন বই পড়া হচ্ছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই ‘একাডেমিক’। গল্প-উপন্যাস এখন আর তেমন পড়া হয় না। সে জন্য মনের গোপনে একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে। এত কাজের চাপেও অবশ্য কবিতা পড়ার নেশাটা ছাড়তে পারিনি।
আমার প্রিয় বইয়ের তালিকাটা বেশ লম্বা। এর মধ্যে আছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রার তীরে, তারাশঙ্করের বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি, শঙ্করের চৌরঙ্গি, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন। বিশ্বাস করি, এসব বই-ই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, অরুন্ধতী রায়ের সব লেখাই আমাকে অসম্ভব টানে। তাঁর কোনো লেখা যখনই হাতের কাছে পাই, আগ্রহ নিয়ে পড়ি। টোকন ঠাকুরের কবিতার ভক্ত আমি। অসম্ভব ‘মেজাজ’ আছে তাঁর কবিতায়।
আগে উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে একটা বিষয় প্রায়ই হতো। যে উপন্যাসটা যখন পড়তাম, কোনো চরিত্র ভালো লাগলেই নিজেকে তার মতো ভাবতাম। যখন ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়েছি, নিজেকে কিশোর মনে হতো। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দূরবীন যখন পড়ছি, রেমির প্রতিটি কথা মুখস্থ হয়ে গেছে। দেখা গেল, একা একই ওর সংলাপগুলো আওড়াচ্ছি। আবার যখন সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন-এ ডুবে গেলাম, তখন আমি দীপাবলী। তারাশঙ্করের কবি পড়তে পড়তে ঠাকুরঝির চরিত্রটা আমাকে পেয়েই বসেছিল। মনে মনে খুব চাইতাম, এই চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ যেন পাই।
তবে, ওই যে বললাম, পড়ার মধ্যে গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কবিতাই আমাকে বেশি টানে। কবিতা পড়তে পড়তে আমি কবির ভেতরে কী বাস করে, কোন অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি কবি হয়েছেন, সেই কথা খুব জানতে ইচ্ছা করে।
আমার দীর্ঘ পাঠকজীবনে যে মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন, আছেন, থাকবেন—তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যেমন, কখনো ভীষণ মন খারাপ, কী করব ভাবছি, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মুখ গুঁজেছি। মা বকা দিয়েছেন, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া—তাতেও আছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার অকারণেই মনটা হঠাৎ খারাপ। কোনো কাজে মন বসছে না। তখন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ-এর দুটি গল্প পড়তেই মন চাঙা হয়ে যায়। অভিনয় করতে গিয়ে, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে বারবার রবিঠাকুরের দ্বারস্থ হয়েছি।
অনুলিখন: সুচিত্রা সরকার