Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা থেকে সেরে উঠেছি

ইতালিতে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। বাঁচার আকুতি নিয়ে চলে আসি দেশে। কিন্তু সেই ভয় আর আতঙ্ক পিছু ছাড়ল না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম কয়েকজন বাংলাদেশির মধ্যে আমি একজন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যখন আমাকে হাসপাতালের একটি কক্ষে একা রাখা হলো, তখন আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। হতাশা আর দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তার রহমতে এখন সুস্থ হলেও মনের মধ্যে সেই লুকানো ভয়টা এখনো কাজ করছে।

৩ মার্চ আমি ইতালি থেকে দেশে আসি। রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে এসে ভালোই ছিলাম। কিন্তু তিন-চার দিন পর শরীরে ব্যথা অনুভব করি। পরে জ্বর, কাশি ও বমি হয়। তখন বুঝতে পারি আমার কিছু একটা হয়েছে। দিন যায় কিন্তু জ্বর যখন কমছিল না। বিমানবন্দরে পাওয়া করোনাভাইরাসসংক্রান্ত আমার কাছে একটি কার্ড ছিল। সেই কার্ডে পেয়েছিলাম রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইন নম্বর। ৬ মার্চ সেই নম্বরে ফোন করি। ইতালি থেকে ফেরার কথাসহ আমার শারীরিক অবস্থার কথা তাদের খুলে বলি। তারা পরামর্শ দেয় ঢাকায় যাওয়ার। প্রতিষ্ঠানটির কথামতো ৭ মার্চ ঢাকায় চলে যাই। আইইডিসিআরে আমার কয়েকটি পরীক্ষা করা হয়। সে দিনই আমাকে জানানো হয়, আমি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছি, আমার চিকিৎসা প্রয়োজন। 

একটি গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি সরকারি হাসপাতালে। সেখানে আমাকে ভর্তি করানো হয়। চারতলা একটি ফ্ল্যাটে আলাদা ঘরে রাখা হয়। আমার জ্বর ও বমি হলে চিকিৎসকেরা প্যারাসিটামল, কাশি ও বমির ওষুধ দিতেন। সেখানে কোনো সমস্যা অনুভব করলে, আমি আইইডিসিআরের দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করতাম। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিত। 

হাসপাতালে আমাকে যাঁরা দেখাশোনা করতেন, তাঁরা নানাভাবে মনোবল জোগাতেন। বলতেন, বয়স কম দ্রুতই নাকি সুস্থ হয়ে উঠব। তবুও নিজের মধ্যে কাজ করত নীরব যন্ত্রণা, মৃত্যুভয়, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একা থাকার কষ্টও বোঝাতে পারব না। হাসপাতালে রোজ সকালে দুটি রুটি, কলা আর ডিম খেতে দিত। দুপুরে ভাত, মাছ ও রাতেও ভাতের সঙ্গে মাংস বা মাছ ছিল। খাবারে কোনো সমস্যা ছিল না। তবে আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমার পরিবারের সদস্যদের আসা নিষেধ ছিল। দীর্ঘদিন পর দেশে এসেছি, কিন্তু স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারছি না, পীড়া দিত ব্যাপারটা! তখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। 

কিন্তু তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছিল। এসব মৃত্যুর খবরে আমার পরিবার আমাকে নিয়ে খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তখন একবার মা-বাবাকে দেখার জন্য মন আকুলিবিকুলি করছিল। কারণ, একসময় মনে হয়েছিল আর হয়তো বাড়ি ফিরতে পারব না, মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে না।

হাসপাতালে ছয় দিন কাটানোর পর আমি সুস্থ হই। কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে জানাল, আজ করোনাভাইরাস নেগেটিভ এসেছে, আপনি শঙ্কামুক্ত। তখন মনে হলো আমি নতুন পৃথিবীর আলো দেখতে পাচ্ছি। মনের মধ্যে আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলাম না, চোখে পানি চলে আসে। 

আইইডিসিআরের গাড়িতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। তারা বলেছে ঘর থেকে না বের হতে। করোনাভাইরাস না থাকলেও এখনো ঘরেই থাকছি। কিন্তু এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এলাকার লোকজন দূর থেকে আমাকে দেখেও ভয় পায়। পরিবারের লোকজনকে দেখে ভয় পায়। তাদের এড়িয়ে চলে। আমার পরিবারের সদস্যরাও সতর্কতা মেনে চলছে, ঘরে থাকার চেষ্টা করছে।

করোনাভাইরাস আমার কাছে দুর্ভাগ্যের এক নাম। ইতালি থেকে একসঙ্গে একই উড়োজাহাজে কতজনই তো এলাম। কেউ আক্রান্ত হলো না, শুধু আমিই দুর্ভাগা আক্রান্ত হলাম। তবুও আশার কথা, এখন সুস্থ আছি, এখনো বেঁচে আছি, এটাই বড় ব্যাপার।

অনুলিখিত
১৯ মার্চ ২০২০