Thank you for trying Sticky AMP!!

কেন তুমি ওর চেয়ে কম পেলে?

পরীক্ষার ফল যা–ই হোক না কেন সন্তানকে উৎসাহ দিন। ছবি: অধুনা

মাইশা (ছদ্মনাম) পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমের একটি নামী স্কুলে ক্লাস ফোরে। ষাণ্মাসিক পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড দিয়েছে। মাইশার সঙ্গে আনতে গিয়েছিলেন তার মা। মাইশা কোনো বিষয়েই খারাপ করেনি, কিন্তু কয়েকটিতে সে তার প্রিয় বন্ধু ও সহপাঠী আইরিনের চেয়ে বেশ কম পেয়েছে। এটা দেখতে পেয়েই মাইশার মা রেগে আগুন। বারবার বলছেন, ‘কেন তুমি আইরিনের চাইতে অঙ্কে সাত সম্বর কম পেয়েছ’, ‘আইরিন কেন সাধারণ জ্ঞানে “এ-প্লাস” আর তুমি “এ” পেলে?”’ ইত্যাদি ইত্যাদি। স্কুলে তো বকেছেনই এমনকি বাসায় ফিরতে ফিরতে পুরো রাস্তায় তিনি মাইশাকে বকতে বকতে ফিরলেন। মাইশা সব বিষয়ে ভালো করেও মন খারাপ করে রইল।

যেকোনো পরীক্ষার ফলাফলের পর এমনটা দেখা যায়। কোনো কোনো মা-বাবা আছেন যাঁরা স্কুলের ভেতরেই আরেক সহপাঠীর রিপোর্ট কার্ড টেনে নিয়ে নিজের সন্তানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে থাকেন। যখন দেখেন তার সন্তান অন্যের চেয়ে ভালো করেছে তখন আত্মতৃপ্তিতে অন্যদের নানা উপদেশ দিতে থাকেন, আর যদি দেখেন নিজের সন্তান অন্য কারও চেয়ে খারাপ করেছে তখন শিশুকে বকেন। হাত ধরে টানতে টানতে স্কুল থেকে বের করে নিয়ে যান, কখনো স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপর নানা রকম দোষারোপ করেন। ফেরার পুরোটা পথ এমনকি বাড়িতে ফিরেও সন্তানকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকেন!

ফল প্রকাশের পর এভাবে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে থাকলে শিশুর বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর মানসিক বিকাশের যে পর্যায়গুলো রয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জ্ঞানীয় বিকাশ বা ধারণার জগতের বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) এবং নৈতিকতার বিকাশ (মোরাল ডেভেলপমেন্ট)। আশপাশের মানুষের আচরণ, পরিবার আর সামাজিক অনুষঙ্গ শিশুর এই বিকাশের ধারাকে প্রভাবিত করে। মা-বাবা যখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিশুকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে তখন শিশুর ধারণা—জগৎটা কেবলই এগিয়ে থাকার, এখানে যেকোনো উপায়েই হোক আরেকজনকে পেছনে ফেলে সামনে যেতে হবে। সহযোগিতামূলক মনোবৃত্তির বদলে তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোবৃত্তি জন্ম নেয়। সেভাবে পেছনে থাকা মানেই হেরে যাওয়া, পরাজয়কে মেনে নেওয়ার গুণাবলি সে ধারণ করতে পারে না, তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। এগুলো তার জ্ঞানীয় বিকাশের ধারাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি শিশুর প্রতি মা-বাবার কটাক্ষ আর ক্রমাগত আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করতে থাকায় তার মধ্যে গড়ে ওঠে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। ফলে সে যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে চায়। এই জয়ী হতে চাওয়ার জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বন করাকেও সঠিক মনে করে। নিজের মধ্যে নানা যুক্তি তৈরি করে এবং নৈতিকতার চেয়েও নিজের জয়ী হওয়াকে প্রাধান্য দিতে থাকে। এতে শিশুর নৈতিকতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। নৈতিকতাকে নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করে।

এগিয়ে থাকার জন্য, আরেকজনকে পেছনে ফেলার জন্য তার রয়েছে পরোক্ষ পারিবারিক অনুমোদন। এসব কারণে নৈতিকভাবে দৃঢ় হতে পারে না। ফলে ভালো ফল করেও তার মধ্যে মানবীয় গুণাবলি আর সামাজিক দক্ষতার অভাব দেখা দেয়। বৈষয়িক দিকে সে সফল হলেও মানুষ হিসেবে পেছনেই পড়ে থাকে। বারবার আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করতে থাকলে একদিকে হীনম্মন্য আর আত্মবিশ্বাসহীন হয়, আরেক দিকে যার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে তার প্রতি আগ্রাসী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব পোষণ করে। এসব বিষয় তার ব্যক্তিত্বের সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলে পেশাগত জীবনে সফল হলেও পারিবারিক আর সামাজিক জীবনে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না এবং একটা সময় পেশাগত দিকেও ব্যর্থ হতে থাকে।

এই বিষয়টি মা-বাবা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন ততই সন্তানের জন্য মঙ্গল। আরেকজন কী পেল, আরেকজনের সফলতা কতটুকু হলো এগুলো পরিমাপ করতে গিয়ে যদি দিনের বেশির ভাগ সময় চলে যায় তবে নিজের সন্তানের পেছনে দেওয়ার মতো গুণগত সময়ের ঘাটতি দেখা দেবে। বিশেষত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করে সমালোচনা করতে বেশি দেখা যায়। এ ধরনের আচরণ অবশ্যই পরিহার করতে হবে, তাতে দিন শেষে নিজের সন্তানেরই মঙ্গল।

 সন্তানের পরীক্ষার ফল দেখে কী করবেন

* সন্তান যে রকম ফলই করুক না কেন তাকে উৎসাহিত করুন। যদি আশানুরূপ ফল না হয় তবে ভবিষ্যতে সে ভালো করবে বলে তাকে আশ্বস্ত করুন। নেতিবাচক মন্তব্য করে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না।

* আরেক সহপাঠী কী ফল করেছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। আরেকজনের ফল আপনার সন্তানের ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

* অন্যের রিপোর্ট কার্ড নিতান্তই ব্যক্তিগত। তাই আরেকজনের রিপোর্ট কার্ড দেখতে চাওয়াটা মোটেই সমীচীন নয়।

* সহপাঠীর ফলের সঙ্গে সন্তানের ফল তুলনা করবেন না। এতে করে শিশুর মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

* অপরের সঙ্গে তুলনা করার কারণে সে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে, ঠিকমতো সামাজিকতা রপ্ত করতে পারে না।

* সন্তান স্বপ্রণোদিতভাবে না জানালে আপনি তার কাছেও জানতে চাইবেন না তার বন্ধু-সহপাঠী কী রকম ফল করেছে।

* শিশুকে তার ফলাফল নিয়ে টিটকারি দেবেন না, ব্যঙ্গ করবেন না।

* সন্তানের ফল আশানুরূপ না হলে সে জন্য স্কুল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করবেন না। সমাজ বা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না।

* তার সহপাঠীর ভালো ফলের পেছনে সহপাঠীদের মা-বাবার কোনো কার্যক্রমকে সমালোচনা করবেন না। তাদের জড়িয়ে কোনো অনৈতিক বিষয়ের অবতারণা করবেন না।

* সন্তানের ফলাফলের জন্য বাড়িতে মা-বাবা একে অপরকে দায়ী করবেন না। পারিবারিক শান্তি বজায় রাখুন।

* সন্তানকে ব্যর্থতা মেনে নিতে শেখান। সফলতার মতো ব্যর্থতাও জীবনের একটি অনুষঙ্গ, এটিকে গ্রহণ করে নিতে পারাও একধরনের সামাজিক দক্ষতা।

* ফল খুব ভালো হলে সংযতভাবে উদ্‌যাপন করুন। একটি ফলই জীবনের সব নয়। তাই সন্তানকে উৎসাহ দিন, প্রশংসা করুন কিন্তু অতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। 

আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।