Thank you for trying Sticky AMP!!

কয়েদি নম্বর ৩০০

প্রতারক ভিক্টর লুস্তিগের হাতে আইফেল টাওয়ার দুবার বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ছবি: লেখক

না, তিনি সঙ্গে কোনো হালকা বা ভারী অস্ত্র কখনোই বহন করতেন না। অন্তত পুলিশ এ রকম কোনো অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে করেনি। কারও কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ হাতিয়ে নিতে তাঁকে জোর প্রয়োগ করতে হতো না। মিষ্টভাষী, পাঁচটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। খুব সুন্দর করে কথা বলাই তাঁর প্রধান অস্ত্র। তা ছাড়া চলাফেরায় পরিপাটি, পোশাকে একদম কেতাদুরস্ত, সর্বত্র আভিজাত্যের নিখুঁত ছাপ। কালো চুল পরিপাটিভাবে ব্যাকব্রাশ করা, সিনেমার নায়কদের মতো পোশাক পরতেন, সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার মতো আকর্ষণীয় চেহারা ছিল তাঁর। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠা-বসা। সব মিলিয়ে কল্পনার রাজপুত্তুরের সঙ্গে মিলে যাবে তাঁর বর্ণনা।

খুব সহজেই তিনি আস্থা অর্জন করতে পারতেন তাঁর সম্ভাব্য শিকারের। নব্য ধনীদের মাত্রাতিরিক্ত লোভকে তিনি কাজে লাগাতেন। কথার জাদু আর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব দিয়ে ঘায়েল করতেন অর্থসম্পদের জন্য লালায়িত মানুষকে। মাঝে থেকে হাতিয়ে নিতেন বিপুল অর্থ।

সুখ্যাতি না পেলেও খ্যাতির অভাব হয়নি বলেই ইতিহাসে পাতায় স্থান করে নিয়েছেন একজন শ্রেষ্ঠ জালিয়াত হিসেবে। ৪৬ বছর বয়সে পা রেখেই আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক কনম্যান বা প্রতারকের খেতাব জুটেছিল তাঁর।

উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, নিন্দিত আবার তাঁর অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার জন্য কারও কারও কাছে নন্দিত এই প্রবঞ্চকের নাম ভিক্টর লুস্তিগ। নামের আগে জুড়ে দিতেন আভিজাত্যের প্রতীক ‘কাউন্ট’ উপাধি। অবশ্য আরও ৪৭টি ভিন্ন ভিন্ন নামে নিজেকে পরিচয় দিতেন। জেলখানায় তাঁর নাম লেখা হয়েছে রবার্ট ভি মিলার। এক ডজন নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন তিনি।

ভিক্টর লুস্তিগ, ডানে। ছবি সৌজন্য: জেফ মেস

ভিক্টর লুস্তিগ ১৯০০ সালের শুরুর দিকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে শুরু করে পকেট মারা, চুরি, মারামারিসহ হেন কোনো কাজ নেই করেননি। এ জন্য ছোটখাটো অপরাধে বেশ কয়েকবার তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে। সে সময় নিজেকে তিনি শহরের মেয়রের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতেন। অথচ তিনি ছিলেন আসলে দরিদ্র এক চাষি পরিবারের সন্তান।

১৯২০ সালে ভিক্টর লুস্তিগ পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে সহজেই তিনি সমাজের উঁচু মহলের অনেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। আর সে সময়ে সবচেয়ে সফল প্রতারণা ছিল ‘রোমানিয়ান মানি বক্স’। ভিক্টর বেশ কিছু লোভী ধনাঢ্য ব্যক্তিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রটির ভেতরে ব্যাংক নোট ঢুকিয়ে ছয় ঘণ্টায় অবিকল আরেকটি নকল নোট ছাপানো সম্ভব। অনেকেই প্রতিটি মেশিন ৩০ হাজার ডলার দিয়ে কিনে নেন। এতে করে অল্পতেই তিনি কোটিপতি বনে যান। তাঁর সেই ধাপ্পাবাজির শিকার হয়েছিলেন সে সময়কার মার্কিন মুলুকের মাফিয়া শিরোমণি আল কাপন।

এরপর ১৯২৫ সালে প্যারিসে চলে আসেন ভিক্টর লুস্তিগ এবং নগরীর কেন্দ্রে প্লাস ডো লা কনকর্ডে একটি অভিজাত হোটেলে ওঠেন। নিজেকে ফরাসি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন। একদিন হঠাৎ একটি খবরের কাগজের সংবাদে তাঁর দৃষ্টি আটকে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ফরাসি সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা নড়বড়ে। আইফেল টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহন করা সরকারের জন্য সাদাহাতি পোষার মতো বিশাল এক বোঝা হয়ে উঠেছে। খবরটা পড়েই লুস্তিগের মাথায় প্রতারণার অভিনব পরিকল্পনাটা আসে এবং এই সুযোগ দারুণভাবে কাজ লাগায় তিনি।

ফ্রান্সের এক মন্ত্রীর লেটারহেড নকল করে তিনি চিঠি লেখেন ফ্রান্সের ধাতবশিল্পের হর্তাকর্তা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে। তাঁদের আমন্ত্রণ জানান বিলাসবহুল হোটেলকক্ষে। এর আগে তিনি আইফেল টাওয়ার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব তথ্য রপ্ত করেন। ব্যবসায়ীদের বলেন, কাজটা খুব গোপনে করতে হবে, কারণ জনগণ জানতে পারলে ঝামেলা হবে। বিশ্বাস আর আস্থা অর্জন করার জন্য লিমুজিনে করে ছয় ব্যবসায়ীকে নিয়ে ১০৬৩ ফুট (৩২৪ মিটার) উঁচু, ১০ হাজার ১০০ টন ওজনের ইস্পাতের বিস্ময়কর স্থাপনা আইফেল টাওয়ার পরিদর্শনও করেন। ছয় ব্যবসায়ীর একজন অঁদ্রে পয়সোঁ, তিনি ফাঁদে পা দেন। তবে তাঁর স্ত্রী ছিলেন সন্দিহান। সন্দেহ দূর করতে লুস্তিগ আরেকটি কূট চাল চালেন, টাওয়ারটি তাঁকে পাইয়ে দেবেন, এমন আশ্বাস দিয়ে পয়সোঁর কাছে তিনি ঘুষ দাবি করে বসেন।

রোমানিয়ান মানি বক্স। ছবি: সংগৃহীত

অঁদ্রে পয়সোঁর ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। আরও অনেক বেশি ধনবান হওয়ার এমন মোক্ষম সুযোগ তিনি ছাড়তে চাইলেন না। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে সেই আমলে নগদ ৭০ হাজার ডলার ধরিয়ে দিলেন ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা ভিক্টর লুস্তিগের হাতে। টাকাপয়সা নিয়ে এই প্রতারণার সহযোগী রবার্ট আর্থারের সঙ্গে ভিয়েনায় চম্পট দেন ভিক্টর লুস্তিগ। আর এদিকে বোকামির খেসারত দিতে গিয়ে অনর্থক বিপুল পরিমাণ অর্থ খুইয়ে অঁদ্রে পয়সোঁ এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, পুলিশে পর্যন্ত নালিশ করেননি।

এখানেই শেষ নয়, আরেকবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে মাত্র ১৬ হাজার ডলারের বিনিময়ে আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দেওয়ার রেকর্ডও আছে তাঁর! তবে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ৭০ এবং ১৬ হাজার ডলার অনেক অর্থ।

পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাল ব্যাংক নোট তৈরিসহ বিভিন্ন প্রতারণায় জড়িয়ে পড়লে তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে বিছানার চাদরকে দড়ির মতো পেঁচিয়ে, জানালার গ্রিল কেটে ম্যানহাটনের ফেডারেল ডিটেনশন সেন্টার থেকে পালতে সক্ষমও হন লুস্তিগ। তার পরও শেষরক্ষা হয়নি, ২৭ দিন পর তাঁকে পিটার্সবার্গ থেকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ছাড়া মোটামুটি আর সব ক্যাটাগরিতে মামলা ছিল তাঁর নামে। অনেকে ধারণা করেন যে, সুযোগ পেলে লুস্তিগ মিসরের পিরামিড কিংবা আগ্রার তাজমহলও বিক্রি করে দিতেন।

৫ ডিসেম্বর ১৯৩৫ তারিখে বিচারে ১৫ বছরের সাজা হয় এবং তাঁকে আলকাট্রাজ দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানা না গেলেও, জেলে তাঁর নতুন নাম হয় ‘৩০০’, কয়েদি হিসেবে এটিই ছিল তাঁর সংখ্যাগত পরিচয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত লুস্তিগ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ রাত সাড়ে ৮টায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুসনদে পেশার জায়গায় লেখা ছিল ‘শিক্ষানবিশ সেলসম্যান’। তবে ভিক্টর লুস্তিগ প্রতারণাকে যে শিল্পে রূপ দিয়েছিলেন, তা বললে অত্যুক্তি হবে না।

লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।