Thank you for trying Sticky AMP!!

চকলেটের উৎস সন্ধানে

বাগানে কোকোয়াগাছ

চকলেটের কথা উঠতেই আমাদের সামনে ভাসে লিন্ডট, ক্যাডবেরি, হার্সে, মার্স, কিটক্যাটসহ আরও কত ব্র্যান্ডের নাম। কিন্তু সুস্বাদু এই চকলেটের মূল উপাদান কী? সে উপাদান আসেই–বা কোত্থেকে? এবার আইভরিকোস্ট সফরে সুযোগ হয়েছিল মনে মনে পুষে রাখা সে প্রশ্নের উত্তর জানার। নানা স্বাদ-বর্ণ-গন্ধের আমাদের পছন্দের চকলেটগুলো কোকোয়া গাছের ফলের বীজ থেকে তৈরি হয়। এমন একটি কোকোয়া বাগান দেখতে গিয়েছিলাম আইভরিকোস্টের রাজধানী আবিদজান থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরের আবয়সো জেলার নিনগু গ্রামে।

ঝাঁকড়া গাছের ফল

হোটেল থেকে আমাদের মাইক্রোবাস যখন নিনগুর পথে ছুটল, ডান দিকে তাকিয়ে দেখি আটলান্টিক মহাসাগর স্থির দাঁড়িয়ে। রাস্তার দুই ধারে কখনো নারকেলগাছের সারি, কখনো পামবাগান আবার কখনো বা রাবারবাগান। পুরো ল্যান্ডস্কেপেই সবুজ ছড়ানো। যেহেতু এর আগে কখনো কোকোয়াগাছ দেখিনি, তাই একটু রোমাঞ্চ নিয়েই অপেক্ষা করছিলাম কখন দেখব সেই গাছ। নিনগুতে যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল। সুখের ব্যাপার হলো, সময়টা মন্দ কাটেনি। যাত্রায় আইভরিকোস্টের চেহারাটা দেখার সুযোগ হলো।

নিনগুতে পৌঁছেই গ্রামের একজনকে বললাম, কোকোয়াবাগানে যেতে চাই। তিনি নিয়ে চললেন পাশের একটা বাগানে। অভ্যর্থনা জানাল সবুজে ঘেরা সে বাগানের শত শত কোকোয়াগাছ! ঝাঁকড়া কোকোয়াগাছগুলো সবুজ বড় বড় পাতায় ভরা। তবে গাছের আকার মাঝারি গোছের। উচ্চতায় ১৮-২০ ফুট হবে। ছায়াময় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে দেখি মাটি ঢেকে আছে ঝরা পাতায়। বাগানের গাছগুলো পাতায় ভরা থাকে বলে খুব হালকা সূর্যের আলো ভেতরে ঢোকে। গরমের মধ্যে প্রশান্তির জায়গা মনে হলো বাগানের ভেতরটা। গাছ সম্পর্কে ছোট একটা তথ্যও জানা গেল, কোকোয়াগাছ চিরহরিৎ প্রকৃতির; পাতার রং সারা বছরই সবুজ থাকে।

কোকোয়া ফল দেখতে যেমন!

গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, হলুদাভ কমলা রঙের কোকোয়া ফল থোকায় থোকায় ঝুলে আছে; অনেকটা আমাদের কাঁঠাল যেভাবে ধরে। তবে কোকোয়া ফল কাঁঠালের মতো বড় নয়। দেখতে অনেকটা লম্বা পেঁপের মতো। আকারে ছয় থেকে দশ ইঞ্চি। শক্ত আবরণে ঢাকা কোকোয়া ফলের মধ্যে থরে থরে সাজানো থাকে বীজ। খোসা থেকে ছাড়িয়ে বীজগুলো কৃষকেরা বাক্সের মধ্যে ভরে মাদুর বা কলার পাতা দিয়ে তিন থেকে সাত দিন ঢেকে রাখেন। এ গাজন-প্রক্রিয়ার সময় কোকোয়ার সেই মাদকতা ছড়ানো গন্ধ তৈরি হয়। তারপর কয়েক দিন ধরে সূর্যের আলোতে এই বীজ শুকানো হয়। শুকানো কোকোয়া বীজ বিক্রি হয় কেজি দরে।

কোকোয়া-বাণিজ্য

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গেও কথা হলো। তাঁদের কাছে জানা গেল, নিনগু গ্রামে কৃষকদের একটি সমবায় সমিতি আছে। কৃষকদের কাছ থেকে সমিতিই কিনে নেয় এই বীজ। তারপর তা চলে যায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্রয়কেন্দ্রে। সেখান থেকে আমেরিকা আর ইউরোপে। বড় বড় নিলামের মাধ্যমে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোকোয়া কেনে চকলেট কোম্পানিগুলো। তারপর নিজস্ব কারখানায় নিজস্ব প্রক্রিয়ায় চকলেট বানায় বিভিন্ন চকলেট কোম্পানি।

পথেই দেখা নিনগু গ্রামের দুই নারীর সঙ্গে

বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কোকোয়া উৎপাদন করে আইভরিকোস্ট। বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন টন কোকোয়া রপ্তানি করে দেশটি, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৪৩ শতাংশ। ক্যাডবেরি এবং নেসলের মতো বড় কোম্পানিগুলো আইভরিকোস্টের কোকোয়ার ওপর নির্ভরশীল। দেশটির রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে কোকোয়া থেকে। আর প্রতিবেশী দেশ ঘানা আর আইভরিকোস্ট মিলে প্রায় ৭০ শতাংশ কোকোয়ার জোগান দেয় সারা বিশ্বে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আইভরিকোস্টের অর্থনীতিতে কোকোয়ার অবদান অনেক বেশি।

বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে কোকোয়া চাষের ওপর বেশ কিছু প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ হয়েছিল। গা শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার হলো, বিশ্বের অন্য কৃষকদের মতো ভালো নেই তারাও। এখানেও সেই একই শোষণ আর বঞ্চনার গল্প। এক কেজি কোকোয়ার বীজ বিক্রি করে কৃষকেরা পান ১ দশমিক ৪ ডলার বা ১১৫ টাকার মতো। অথচ এই বীজই প্রক্রিয়াজাত করার পর অনেক গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, কোকোয়া ফল তোলার মূল সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মার্চ। অল্প পরিমাণে ফল তোলা হয় জুলাই মাসেও। এ সময় খেয়ে-পরে চলার মতো টাকা কৃষকদের হাতে থাকে। সমস্যা হয় এপ্রিল-মে-জুন মাসে। এ সময় তঁাদের হাতে কোনো টাকাপয়সা থাকে না। তৈরি হয় খাদ্যসংকট। আমাদের দেশের ‘মঙ্গা’র সময় যে রকম পরিস্থিতি হতো, অনেকটা সে রকম। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ারের স্থানীয় কর্মী জানালেন, তাঁরা কোকোয়াচাষিদের সঙ্গে কাজ করছেন কাসাভা এবং বাঁধাকপির মতো ফসল ফলানোর জন্য। উদ্দেশ্য, পতিত জমিতে খাদ্যজাতীয় ফসল ফলানোর মাধ্যমে অভাবের সময়ে খাবারের ব্যবস্থা করা। তখন ভাবছিলাম, ৬০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার জোগানদাতাদের কেন না খেয়ে থাকতে হবে?