Thank you for trying Sticky AMP!!

ছড়িয়ে দিই ইতিবাচক ভাবনা

পিয়ার টু পিয়ার—ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
>পিয়ার টু পিয়ার—ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল। তারা জিতে নিয়েছে প্রথম পুরস্কার। ব্রাসেলস থেকে পুরস্কার জয়ের টাটকা অনুভূতি আর এর পেছনের গল্প লিখে পাঠিয়েছেন দলটির সদস্য সওসান সুহা

‘পজিটিভ বাংলাদেশ’—নামটিই আমাদের কাজের প্রতিফলন। চরমপন্থা রোধের এই প্রচারণা সঙ্গে নিয়ে কীভাবে আমরা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে পৌঁছালাম, কেমন করে জিতে নিলাম পিয়ার টু পিয়ার: ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতার শিরোপা, জানতে হলে কয়েক মাস পেছনে ফিরে যেতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের মোটামুটি শুরুর দিকেই পরিচয় আমাদের চারজনের—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তওসীফ তানজিম আহমেদ, সামিন ইয়াসার ও আমি, এবং রোবোটিকস ও মেকাট্রনিকস বিভাগের জুলকারনাইন তাসিন। একসঙ্গে ওঠা-বসা হলেও চারজন চার মেরুর বাসিন্দা। তাসিনের জীবনে দুদণ্ড দাঁড়ানোর ফুরসত এখনো হয়ে ওঠেনি, সামিনের পুরো জগৎ তার গানবাজনাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তওসীফ তার নানা কার্যক্রম দিয়ে ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখছে সারা বছরই। আর আমি? জ্যাক অব অল ট্রেডস, মাস্টার অব নান! 

কথা প্রসঙ্গেই একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে তুমুল আলোচনা হলো নিজেদের মধ্যে। এই যে একদল মানুষ নিরলসভাবে এসব মাধ্যমে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে যাচ্ছে, হিংসা-রাগ-ক্ষোভ-বিভেদের ঝান্ডা তুলে বসে আছে, এর পেছনের কারণ আসলে কী? দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষার অভাব, নাকি একান্তই ব্যক্তিজীবনের গভীর হতাশাবোধ? 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই রাজ্যের বইপুস্তক ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম, অনেকের সঙ্গে দেখা করলাম। সামিনের বাসায় আমাদের ঘাঁটি বেশ পোক্ত হয়ে উঠল। দলে যুক্ত হলো নতুন যোদ্ধা—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের সাইফ মোস্তাফিজ এবং ছোট ভাই আদিব রেজা। 

প্রাথমিকভাবে আমরা যা বুঝলাম, একদল মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়তই নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে মেয়েটা ভিনদেশে পড়তে যাবে বলে পড়ালেখায় ডুবে আছে, যে ছেলে নতুন একটা কিছু আবিষ্কারের নেশায় রাত-দিন হিসাব মেলাচ্ছে, ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে নানা কিছু শিখছে, কিংবা বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন নিয়ে যে তরুণ প্রতিদিন মাঠে অনুশীলন করতে যাচ্ছে—তার মধ্যেও কি নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে? 

আমরা জরিপ করতে শুরু করলাম। যা জানলাম—কোনো কাজে যে মজে আছে, প্রতিভাকে চর্চার মাধ্যমে শানিয়ে তুলতে যে ব্যস্ত, মননশীলতা বিকাশে যে সময় দিচ্ছে—তার তুলনায় একজন উদ্দেশ্যহীন মানুষের চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা বেশি। 

আমরা একটা সহজ লক্ষ্য দাঁড় করালাম। নেতিবাচক নয়, একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করতে হবে। যথাযথ সুযোগ-সুবিধা, সঠিক তথ্যের ঘাটতির কারণে অনেক তরুণ নিজের কোনো পরিচয় তৈরি করতে পারছে না, বিষণ্নতায় ভুগছে। তাদের কাছে নানা রকম সুযোগ, সম্ভাবনার খবর পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করতে শুরু করলাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সম্মেলন, কর্মশালা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো ‘পজিটিভ বাংলাদেশ’–এর যাত্রা। 

পজিটিভ বাংলাদেশ নামে আমাদের একটা ওয়েবসাইট (wearepositivebangladesh.org) আছে। ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটার জন্ম, আমরা যাকে আদর করে ‘অপরচুনিটি হাব’ বলে ডাকি। এ ছাড়া রয়েছে নিজস্ব ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল। বিভিন্ন ইতিবাচকতার গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আছে আমাদের ব্লগ। মজার বেশ কিছু গল্প আমরা কমিক ও স্টপ-মোশন ভিডিওর মাধ্যমেও প্রকাশ করছি। অফলাইন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে আমরা সরাসরি ‘ওয়েজ টু এনগেজ’ প্রচারণা চালাই, শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলি। এই প্রচারণার পরের ধাপ হলো ‘ইন্সপায়ার টু এনগেজ’—যেখানে নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিরা শোনান তাঁদের জীবনের গল্প। আপাতত আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘আবিষ্কার’ হচ্ছে ‘হান্ড্রেড ডেজ অব পজিটিভিটি’—দেশের আশাজাগানিয়া খবর নিয়ে ১০০ দিনের ‘স্টোরি-সিরিজ’। সামনে আসছে আরও নানা কিছু। 

নিজেদের পকেটের বারোটা বাজিয়ে প্রচারণা করতে করতে আমরা যখন মোটামুটি কপর্দকশূন্য, ইউএনডিপি ও আইসিটি ডিভিশন বাংলাদেশ আয়োজিত ডিজিটাল খিচুড়ি চ্যালেঞ্জে হঠাৎ অংশগ্রহণ ও ভাঙাচোরা দল নিয়েই প্রথম রানার-আপ হওয়ার স্বীকৃতি—নতুন করে আমাদের চাঙা করে তুলল। অর্থায়ন পাওয়ার আশায় এরপর আমরা অংশ নিলাম ‘পিয়ার-টু-পিয়ার ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ স্প্রিং ২০১৯ ’–এ। চরমপন্থার প্রবণতা রোধের বার্তা ছড়িয়ে দিতে প্রতি সেমিস্টারে ফেসবুকের অর্থায়নে ও অ্যাডভেঞ্চার্স পার্টনার্সের আয়োজনে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দুম করেই আবিষ্কার করলাম, স্পেন ও নাইজেরিয়ার দুটি দলের সঙ্গে সেরা তিন দলের মধ্যে আমরাও আছি! তারপর ভিসা আর যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যে বিপত্তি—সে গল্প না হয় তোলা থাক। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, সারা বিশ্বের প্রায় ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে আমরা জিতে নিয়েছি প্রথম স্থান, পুরস্কার হিসেবে আমাদের কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে পেয়েছি ৫ হাজার মার্কিন ডলার। পুরস্কার জয়ের আনন্দ সঙ্গে নিয়েই আমাদের নেটওয়ার্কটা আরও বড় করতে এখন চষে বেড়াচ্ছি ইউরোপের নানা শহর। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও দুজন—অর্থনীতি বিভাগের মাহদী হাসান সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মোহাম্মদ সিফাত যোগ দিয়েছেন আমাদের দলে, যাঁদের অসামান্য অনুপ্রেরণা ছাড়া এত দূর আসা কখনোই সম্ভব হতো না। এ ছাড়া কৃতজ্ঞতা যেই বিশাআআআল তালিকা, সেটা বলা শুরু করলে থামা কঠিন হয়ে যাবে। অতএব থাক। 

খুবই আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছি আমরা, কিশোর-তরুণদের আগ্রহ, জিজ্ঞাসা ক্রমেই কাজের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখনো অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, হাজারো তরুণের স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার তাদের সামনে তুলে ধরা বাকি। অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলা এই প্রকল্প যদি আশার আলো ছড়াতে পারে, বুঝব আমাদের নির্ঘুম রাতগুলো সার্থক হয়েছে।