Thank you for trying Sticky AMP!!

জলে ভাসা পেয়ারা হাটে

জলের ওপর জলজ্যান্ত পেয়ারার হাট। ছবি: লেখক

একদম নড়াচড়া করা যাবে না, এই শর্তে সওয়ার হলাম ছোট্ট ডিঙি নাওয়ে। গলুইয়ের কাছে কোনোমতে উঠে বসেছি। ক্যামেরাটা তো এবার বের করতেই হয়। তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। আমি তো নড়াচড়া করিনি, তবে কি মাঝিই দায়ী! যে-ই কাজটা করুক, সর্বনাশ হলো আমারই। নৌকা উল্টে একেবারে পানিতে আবিষ্কার করলাম নিজেকে—ক্যামেরা আর নতুন কেনা মুঠোফোন-সমেত। আশপাশের লোকজনের চিৎকার কানে এল, একসময় দেখি আমি পানি ছেড়ে ডাঙায়, হাতে ক্যামেরা আর পকেটে ফোন। এর মধ্যে কয়েকজন এসে ক্যামেরা হাত থেকে নিয়ে গেল, আমি গামছা দিয়ে গা মোছায় মন দিলাম।
এসেছি ঝালকাঠির ভিমরুলি জলবাজারে। হ্যাঁ, পানির ওপর জলজ্যান্ত এক হাট। এ হাটের পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর সবুজ–হলুদ পেয়ারা। হাটুরেদের হাঁকডাকে সরগরম। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখেই অবাক আমরা। খালের ওপর এ এক আজব বাজার।

.

ভিমরুলি জলবাজার দেখতেই এবার আমাদের বরিশাল-যাত্রা। সঙ্গী হলেন বন্ধু নাজমুল হক। সারা রাত লঞ্চ-যাত্রার পর ভোরে পৌঁছালাম বরিশাল। লঞ্চ ঘাট থেকে বের হয়ে নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে যাব স্বরূপকাঠি খেয়াঘাট। নতুন জায়গায় নিজেরা সব ব্যবস্থা করে খেয়াঘাট যখন পৌঁছাই, তখন সকাল প্রায় নয়টা বাজে। এখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য ট্রলার ভাড়া করা ছিল। জলযাত্রা শুরু হলো আমাদের।
সন্ধ্যা নদী পেছনে ফেলে কুরিয়ানা খাল ধরে এগিয়ে চলেছি ঝালকাঠির ভিমরুলি জলবাজারের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বরূপকাঠি পার হয়ে চলে আসি মাহমুদকাঠি। মাহমুদকাঠিতেও রয়েছে জলবাজার। এখানে নানা রকম গাছের চারা বিক্রি হয়। মাহমুদকাঠি পার হতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। হোগলা, সুপারি, আমড়া আর পেয়ারার বন চারপাশে। যতই সামনে এগোচ্ছি, খাল ততই সরু হচ্ছে। কখনো ক্যামেরার চোখে দেখে সে দৃশ্য বন্দী করে নিচ্ছি।
কুরিয়ানা খালে গেলেই বুঝবেন জোরে ট্রলার চালানো এখানে সম্ভব নয়। আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে ফুরফুরে এক জলভ্রমণ হয়ে যাবে। স্বরূপকাঠি, মাহমুদ কাঠি—এরপর আদমকাঠি, এভাবেই একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম ঝালকাঠি। এটাই ভিমরুলি, জলে ভাসা পেয়ারার হাট বা জলবাজার। আমরা কুরিয়ানার খালে চলতি পথে দেখেছি গাছ থেকে পেয়ারা নামানোর দৃশ্য। সারি সারি ডিঙি নাও বোঝাই করে পেয়ারা নিয়ে বাজারে নিয়ে আসার দৃশ্য। ভিমরুলি এসে পেয়ারা আর কোষা নৌকা ছাড়া চোখে পড়ল না আর কিছুই। অবশ্য বেপারিদের ট্রলার ছিল। পেয়ারার খদ্দের আর পেয়ারার মালিকের হাঁকডাক ছিল। শুক্রবার বলেই হয়তো—ছিল বেশ কিছু পিকনিক ও পর্যটক ট্রলার। ট্রলার থেকে নেমে জলবাজারের আর একটু ভেতরে যেতে চেয়েছিলাম কোষা নৌকায় চেপে। সেখানেই সেই জলপতন। ক্যামেরাটা বাঁচানো গেল না, তবে মেমোরি কার্ডের ছবিগুলো আছে।
আমরা ঘণ্টা তিনেকের মতো ভিমরুলি জলবাজারে ছিলাম। স্থানীয় ব্যক্তিরা একে বলে গোইয়ার হাট। বাজার ঘুরে ঘুরে পেয়ারা চাষি, ক্রেতা ও অতিথিদের আনন্দ দেখলাম। আবার কষ্টও চোখে পড়ল। সকালের দিকে পেয়ারা বিক্রি হচ্ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মণ দরে। সেই পেয়ারা বেলা পড়ার পরই দাম পড়ে গেল মণপ্রতি ১০০ থেকে ৬০ টাকায়। এক চাষি বললেন, ‘গোইয়া বেচুম কী, দাম কইতে গিয়া কান্দন আহে। এক মণ পেয়ারা ষাইট ট্যাকা হয়, কন দেহি দাদা!

.
জেনে নিন
ডুমুরিয়া, আটঘর, বেতলা, ডালুহারসহ ঝালকাঠির বেশির ভাগ গ্রাম পেয়ারা চাষের জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিন সেসব পেয়ারা বিক্রি হয় আটঘর, কুরিয়ানাসহ ভিমরুলির জলবাজারে। ঝালকাঠির সবচেয়ে বড় জলবাজারটি বসে ভিমরুলিতে। সকাল আটটার মধ্যে বাজার বসে বেচাকেনা চলে বিকেল পর্যন্ত। এখানে আসতে চাইলে ঢাকা থেকে বরিশালের লঞ্চ ধরতে হবে। আসতে হবে ঝালকাঠি। সরাসরি ঝালকাঠির লঞ্চ থাকলেও বরিশালের লঞ্চগুলো আরামদায়ক। বরিশাল নেমে চলে আসুন নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে স্বরূপকাঠি যাওয়ার বাস পাবেন। তবে দলবেঁধে গেলে অটোরিকশার যাত্রী হয়ে যান। এবার স্বরূপকাঠি খেয়াঘাট নেমে রিজার্ভ ট্রলারে চলে আসুন ভিমরুলি জলবাজার। দরদাম করে তবেই ট্রলারে উঠুন। ভাড়া সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা সারা দিনের জন্য। হাতে সময় থাকলে আটঘর ও কুরিয়ানাও দেখে আসতে পারেন। সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখুন। কোষা নৌকায় সাবধানে উঠবেন। অভ্যাস না থাকলে একটু বিপজ্জনকই বটে। বিপদ যদি না-ও ঘটে, আমার মতো আপদ আপনিও ঘটিয়ে বসতে পারেন।