Thank you for trying Sticky AMP!!

তাঁতশিল্পের কর্মীদের ৫৬ শতাংশই নারী

কাপড় বুনছেন এক নারী। রাঙামাটি সদরের কাটাছড়ি গ্রামে। ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জামদানি শাড়ির কারখানা বাংলাদেশ জামদানি ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করছেন আটজন নারী। কারখানার স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল বারেক বললেন, ‘বাড়িতে ১২টি তাঁতে আগে কোনো নারী না থাকলেও দিন দিন সংখ্যাটি বাড়ছে। একেকজন নারী শ্রমিক ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতন পান। দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত করতে হয় আমাকেই।’ 

শুধু রূপগঞ্জের এই কারখানায় নয়, পুরো রূপগঞ্জেই জামদানির কারখানায় আগের চেয়ে নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। মালিকেরা এর কারণ হিসেবে জানালেন, পুরুষ কর্মীরা এ কাজ ছেড়ে তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা বা অন্য বিকল্প পেশায় যাচ্ছেন। অন্যদিকে নারীরা তাঁতশিল্পে যুক্ত হচ্ছেন।

তাঁতশিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে তাঁতশুমারি ২০১৮ এর ফলাফলেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত শুমারি প্রতিবেদন বলছে, এখন তাঁতশিল্পে কাজ করা জনবলের প্রায় ৫৬ শতাংশই নারী। এর আগে ২০০৩ সালের শুমারিতে নারীর সংখ্যা ছিল মোট জনবলের প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর ১৯৯০ সালের তাঁতশুমারিতে এ শিল্পে ৪৪ ভাগের বেশি ছিলেন নারী কর্মী। সর্বশেষ শুমারি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে জুন মাসে। 

তাঁতশুমারির দায়িত্বে থাকা বিবিএসের উপপরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ বললেন, সার্বিকভাবে তাঁতশিল্পে কর্মরত জনবলের সংখ্যা কমছে। তবে বেনারসি ও জামদানি এবং কোমর তাঁতে জনবল আগের চেয়ে বেড়েছে বা আগের মতোই আছে। কোমর তাঁতের বেশির ভাগই নারী পরিচালিত। 

সাধারণত শুমারি হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের আবর্তে। যেমন আদমশুমারি হয় প্রতি ১০ বছর অন্তর। তাঁতশুমারিতে এই নিয়ম মানা হয় না। এর কারণ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমেদ বললেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তাগিদেই বিবিএস শুমারি করে। তাই সময়ের এই হেরফের। পিট, চিত্তরঞ্জন (আধা স্বয়ংক্রিয়), কোমর, ফ্রেম, বেনারসি ও জামদানি, শতরঞ্জি, পাওয়ারলুম-অটো মেশিন-এই সাত ধরনের তাঁতের ওপরই জরিপ হয়। 

এখন তাঁতশিল্পে মোট জনবল ৩ লাখ ৬ হাজার ৩১৫। এর মধ্যে নারী ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৭০। আর পুরুষের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৫। ২০০৩ সালে মোট তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখের বেশি। সর্বশেষ শুমারিতে এ সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। ৭ ধরনের তাঁতের মধ্যে ৪১ শতাংশই কোমর তাঁত। মহিউদ্দিন আহমেদ বললেন, পার্বত্য তিন জেলায় কোমর তাঁতের সংখ্যা বেড়েছে। এ শিল্পে নিয়োজিত নারী কর্মীর সংখ্যাও সেখানে বেড়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ও পর্যটনশিল্প বেড়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে। 

>তাঁতশিল্পে কাজ করা জনবলের প্রায় ৫৬ শতাংশই নারী
কোমর তাঁতের বেশির ভাগই নারী পরিচালিত


রাঙামাটির তাঁতশিল্পের প্রথম প্রতিষ্ঠান বেইন টেক্সটাইলের প্রধান মঞ্জুলিকা চাকমা ১৯৬৫ সাল থেকে এ ব্যবসায় জড়িত। একসময় বেইনই ছিল পার্বত্য তিন জেলার তাঁতশিল্পের প্রতিষ্ঠান। এখন রাঙামাটিতে অন্তত ১২টি প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। বেইনের তাঁতগুলো পরিচালনায় এখনো নারীরাই বেশি বলে জানান মঞ্জুলিকা চাকমা। কারখানায় উৎপাদনের পাশাপাশি বাড়ি থেকেও তাঁতের পোশাক সংগ্রহ করে বেইন। এ কাজে প্রায় সবাই নারী। তাঁরা নির্দিষ্ট অর্ডার নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেন। 

তাঁতি এবং তাঁতি সহযোগী—উভয় ক্ষেত্রেই নারী বেশি এ শিল্পে। পুরুষ তাঁতি সহযোগীদের সংখ্যা সাড়ে ২৪ হাজার। এ ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আর পুরুষ তাঁতির সংখ্যা ১ লাখের কিছু বেশি। আর এ ক্ষেত্রে নারী তাঁতির সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৮। তাঁতশিল্পের নতুন নতুন উদ্যোক্তাও হচ্ছেন নারীরা। অনেকে অনলাইন শপিংকে বেছে নিচ্ছেন ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে। সফলও হচ্ছেন। এমন একজন রাঙামাটির এস এস হ্যান্ডিক্র্যাফটস অ্যান্ড ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী শিরিন সুলতানা। তিনিও নারীদের কাছ থেকে পোশাক নিয়ে বিক্রি করেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে। শিরিন সুলতানা বলছিলেন, ‘তাঁর প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকারীদের ৮০ শতাংশই নারী। নতুন একটা পোশাক বানিয়ে অনলাইনে ছেড়ে দিই। আর সঙ্গে সঙ্গে সাড়া মেলে।’ 

তাঁত পরিবার বা খানার সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে ১ লাখ ২ হাজার ৭০৭ পরিবারই গ্রাম অঞ্চলের। 

তাঁতশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁতশিল্পের সঙ্গে দেশের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। গ্রামেই ঘটেছিল এর উদ্ভব ও বিকাশ। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, এটি একটি বিকেন্দ্রীকৃত শিল্প। এখন শহরের ওপর চাপ কমানোর কথা বলা হচ্ছে। গ্রামনির্ভর এই শিল্প তাই অর্থনীতির একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর মনে করেন, শিল্পটি ঘর বা বাড়িনির্ভর হওয়ায় নারীদের জন্য বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাঁরা ঘরের কাজকর্ম দেখভালের পাশাপাশি এ কাজে সময় দিতে পারেন। 

 হোসেন জিল্লুর বলছিলেন, এ খাতে কর্মী কমে যাওয়ার প্রবণতায় মনে হতে পারে এটি একটি বিলীয়মান শিল্প। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও খাতের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আনাটা জরুরি। তখনই এটি আরও সক্রিয় একটি শিল্প হবে। 

তাঁতশিল্পে পাওয়ার লুমের দিন দিন বাড়-বাড়ন্তের কথা বলেন শিল্পসংশ্লিষ্টরাও। এ জন্য নতুন পুঁজি ও সরকারি সুদৃষ্টি কামনা করেন মঞ্জুলিকা চাকমার মতো পুরোনো উদ্যোক্তারাও।