Thank you for trying Sticky AMP!!

তিন সেরার প্রিয় পাঁচ বই

>

ভালো ফলাফলের জন্য তাঁদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনাম আছে। তাঁরা আবার ভালো পাঠকও বটে। তিন মেধাবী শিক্ষার্থী লিখেছেন তাঁদের প্রিয় পাঁচটি বইয়ের কথা

মৌমিতা হক খান, শিক্ষার্থী, তৃতীয় বর্ষ, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভালোবাসি গান, তাই রবীন্দ্রনাথে সঁপেছি প্রাণ

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে নানা ধরনের বই পড়তে হয়। তবে এসব বই কখনো ‘পাঠ্যবই’ মনে হয় না। কারণ, আমার ভেতরের পাঠকসত্তার জন্ম হয়েছিল খুব ছোটবেলায়।

ছোটবেলা থেকেই গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমার একটা গভীর কৌতূহল আছে। আমার পড়া সেরা পাঁচ বইয়ের কথা বলতে গেলে তাই প্রথমেই আসবে তাঁর একটি উপন্যাসের কথা। নাম যোগাযোগযোগাযোগ পড়তে গিয়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কুমুদিনীর সঙ্গে আমার যেন একটা অদ্ভুত যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেল। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে একজন বুড়ো ধনবান লোকের সঙ্গে কুমুর বিয়ে হলো।

এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে রবিঠাকুর যেভাবে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, বেশ লেগেছে। মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে কুমুর চরিত্রায়ণ এবং তার অসহায় আত্মসমর্পণ। এমন করে লিখতে শুধু রবীন্দ্রনাথই পারেন।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও জেনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম আলো পড়ে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর কাছে ঋণী। ইতিহাস যে এত উপভোগ্য হতে পারে, তা সুনীলের সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব-পশ্চিম বইগুলো না পড়লে জানাই হতো না। কিছুটা কল্পনা আর বেশির ভাগই সত্য ঘটনা অবলম্বনে দেশভাগের সময়টা তুলে ধরেছেন তিনি। তাই আমার দ্বিতীয় পছন্দ প্রথম আলো

তৃতীয় অবস্থানে আছে জেন অস্টেনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস। রোমান্টিক উপন্যাসের তালিকায় এটি আমার পছন্দের শীর্ষে। গল্পের প্রধান চরিত্র এলিজাবেথ ও মি. ডারসির নাটকীয় অথচ বাস্তবতায় আবদ্ধ রোমান্স, তাদের একজনের চারিত্রিক ও মানসিক উন্নয়নে অপরের যে ভূমিকা, তার সঙ্গে যেন সহজেই নিজের জীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পের শেষে এসে মি. ডারসি যেন সব নারীরই প্রিয় মানুষ হয়ে দাঁড়ায়। এই উপন্যাসের আরেকটি দিক হলো, ১৮১৩ সালে যখন নারীদের ভোটাধিকার কিংবা শিক্ষা লাভের অধিকার ছিল না, সেই সমাজের একটা চিত্র পাওয়া যায়। রোমান্টিক উপন্যাসের আড়ালে অস্টিন এই দিকটিও সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়া শুরু করার পর থেকে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে। জালালুদ্দিন রুমির সুফি কবিতা ছিল এর মধ্যে অন্যতম। এলিফ শাফাকের লেখা দ্য ফরটি রুলস অব লাভ এই ধারার সঙ্গে আমাকে আরও ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। জালালুদ্দিন রুমি, তাঁর সুফিজম, তাঁর গুরু শামস অব তাবরিজ এবং এই গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক যে কী মধুর ছিল, এবং তাদের এই সম্পর্ক যে পরস্পরের লেখনীতেও নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে; এলিফ শাফাক বইটিতে তা-ই সহজভাবে তুলে ধরেছেন।

সবশেষে বলব খালেদ হোসাইনির দ্য কাইট রানার–এর কথা। খালেদ হোসাইনির গল্পের যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে, সেটি হচ্ছে তাঁর লেখার সারল্য। এত সহজ কথা, অথচ মনের ভেতর এমনভাবে দাগ কাটে যে তার রেশ থাকে অনেক দিন। সহজ-সরল কাহিনির মধ্য দিয়ে তিনি বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, বিশ্বাস, অপরাধ, প্রায়শ্চিত্তের মতো গভীর বিষয়গুলো যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের তৎকালীন দ্বন্দ্ব, শ্রেণিব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের করুণ পরিস্থিতি এত হৃদয় নিংড়ানোভাবে তুলে ধরতে আমি খুব কম লেখককেই দেখেছি।

স্বরিত আহমেদ, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, কেমিকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

বাংলাদেশকে লেখক ‘বৃষ্টির ঠিকানা’ বলেছেন

বুয়েটে পড়ার সময় আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা ইন প্যারিস অব আইডলনেস অ্যান্ড আদার এসেজ। এটি লেখকের সমাজবিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থনীতি নিয়ে লেখা কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন। মূল প্রবন্ধে লেখক অলসতা সম্পর্কে প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। লেখকের মতে আমাদের কাছে যে প্রযুক্তি আছে, তা দিয়ে সবার অন্নবস্ত্রের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাই জীবিকা নির্বাহের জন্য দিনে চার ঘণ্টার বেশি কাজ করা উচিত নয়। বাকি সময়টুকুতে মানুষ করবে তাঁর পছন্দের কাজগুলো। যেমন ছবি আঁকা, গবেষণা করা ইত্যাদি। পেটের কথা না ভেবে মানুষ এই কাজগুলো করবে মনের আনন্দের জন্য। কী সুন্দর কথা! তাই না? লেখাটি ১৯৩০–এর দশকের হলেও বর্তমান কর্মব্যস্ত যুগের জন্য আরও বেশি প্রযোজ্য।

বুয়েটের ক্লাস শুরুর আগে আমি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা দেশে বিদেশে বইটি পড়ি। লেখক কাবুল কৃষি কলেজের শিক্ষক থাকাকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর সহজাত রম্য রসাত্মক বর্ণনায় তৎকালীন আফগান সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। লেখকের আফগান ভৃত্য আবদুর রহমান থেকে শুরু করে বাদশা আমানুল্লাহ পর্যন্ত আফগান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা রয়েছে এতে।

ক্লাস টেনে পড়ার সময় পড়েছি মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বৃষ্টির ঠিকানা। প্রধান চরিত্র টুম্পার সঙ্গে তার ছোটবেলায় আলাদা হয়ে যাওয়া বাবার সম্পর্ক গল্পের মূল বিষয়। প্রবাসী বাঙালির জীবন, বিশেষ করে বাংলাদেশি কিশোরেরা প্রবাসে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, সেগুলো উঠে এসেছে বইতে। বইটি পড়ার সময় আমার বয়স টুম্পার কাছাকাছি ছিল। সে জন্যই বোধ হয় খুব সহজে গল্পটা আমাকে ছুঁয়ে যায়। সবচেয়ে যে বিষয়টা ভালো লেগেছে, বৃষ্টির ঠিকানা বলতে লেখক আসলে বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মতো সুন্দর বৃষ্টি পৃথিবীর কোথাও হয় না। আমার শৈশবের কিছু সময় সুনামগঞ্জে কেটেছে। তাই এই সুন্দর বৃষ্টি আমি দেখেছি।

আমার প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সব সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছোটগল্পগুলোই সবচেয়ে প্রিয়। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি গল্পগুচ্ছ বইটি পড়ি। এটি কবিগুরুর মোট ৯১টি ছোটগল্পের সংকলন। আমার প্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ছুটি, কাবুলিওয়ালা, ঠাকুরদা, ইচ্ছাপূরণ এবং অধ্যাপক। রবিঠাকুরের প্রায় প্রতিটি গল্পের চরিত্রগুলোতে নিজেকে কল্পনা করা যায় এবং কাহিনিগুলো নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে মেলানো যায়। এটা খুব অদ্ভুত লাগে।

ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা ভোলগা থেকে গঙ্গা পড়েছি ক্লাস সেভেনে। ইউরোপের ভোলগা নদীর তীরে বসবাস করত আর্যরা। মধ্য এশিয়া, হিন্দুকুশ এবং হিমালয় পাড়ি দিয়ে কীভাবে তারা ভারতের গঙ্গাতীরে এল, সেই কাহিনি লেখক বর্ণনা করেছেন বিশটি ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে। কাহিনি ও চরিত্রগুলো লেখকের কল্পনাপ্রসূত হলেও গল্পে ফুটে ওঠা মানুষের জীবনযাপনের রীতিনীতি, বিভিন্ন কালের এবং স্থানের বর্ণনা ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে রচিত। পড়ার মজার পাশাপাশি তাই জানার আনন্দটাও পাওয়া যায়।

জান্নাত আরা আকতার শিক্ষার্থী, শেষ বর্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জন্মেরও আগে থেকে

আমার মা-বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। দুজনই বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। শুনেছি, বিয়ের আগে মায়ের মন জয় করতে বাবা তাঁকে বই উপহার দিতেন। মা এতই বইয়ের পোকা, আমার ডাকনামটা তিনি ধার করেছিলেন একটা বই থেকে। আমি যখন মায়ের পেটে, মা তখন ফরাসি কবিতার বই পড়ছিলেন। বইতে একটা ছোট্ট ছেলের কথা ছিল, নাম রিভা। ছেলেটা খুব দুষ্টু, কারও কথা শোনে না, কিন্তু সবাই তাকে ভালোবাসে। মা তখনই ঠিক করে ফেলেছিলেন, ছেলে হোক মেয়ে হোক তিনি তাঁর সন্তানের নাম রিভা রাখবেন। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। জানিয়ে রাখি, আমার ডাকনাম রিভা। অতএব বলা যায়, বইয়ের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল জন্মেরও আগে। যখন পড়তে শিখেছি, হাতের কাছে যা পেয়েছি, তা-ই পড়েছি।

পছন্দের হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে মাত্র পাঁচটা বই নিয়ে কিছু লিখতে হবে ভেবে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, যে বইগুলো পড়ে ভালো লেগেছে, শুধু সেগুলোর কথা আমি লিখব না। আমি বলব সেই বইগুলোর কথা, যেগুলো আমার ভাবনার জগতে একটা বড় পরিবর্তন এনেছে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখকদের একজন। আমার মনে হয় তাঁর সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে তাঁর লেখনীই সবচেয়ে সাবলীল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা জননী আমার প্রিয় উপন্যাস। এর অন্যতম কারণ হলো, উপন্যাসের মূল চরিত্র একজন নারী। তা ছাড়া গল্পের একটি চরিত্র বিধানচন্দ্র বা বিধু, আমার মনে হয় যেকোনো মেয়ে এই বইটা পড়লে বিধুর প্রেমে পড়ে যাবে। চরিত্রটার মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে। আমার চোখে দ্বিতীয় সেরা বইয়ের নামেও কাকতালীয়ভাবে ‘জননী’ শব্দটা আছে। জোছনা ও জননীর গল্প। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা ও কল্পনাকে তিনি এত সুন্দর করে ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়েছেন, বইটা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখবে এটা নিশ্চিত। আমার বাসায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র আছে। আমি তৃতীয় খণ্ড পর্যন্ত পড়েছি। তবে মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি জোছনা ও জননীর গল্প পড়ার পর।

ভ্লাদিমির বইকোর লেখা ইউক্রেনের লোককথা আমার প্রিয়পাঠ্য থেকে বাদ দেওয়ার উপায় নেই। সাহিত্য সমালোচকেরা এই বইটিকে কতটুকু গুরুত্ব দেবেন জানি না। তবে এই বইয়ের পাতায় পাতায় আমার ছেলেবেলার অসম্ভব ভালো কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যখন মন খারাপ হয়, এই বইটা আমাকে একরকম শান্তি দেয়।

ছেলেবেলার আরও স্মৃতি জড়িয়ে আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর সঙ্গে। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, বাসায় একজন শিক্ষক আমাকে পড়াতেন। তিনি বইটা উপহার দিয়েছিলেন। আমার একটা অভ্যাস, খাওয়ার সময় বই খুলে বসি। পড়া বইটাই আবার পড়ি। পথের পাঁচালী যে কতবার পড়েছি তার হিসাব নেই। অপু-দুর্গার ভাই-বোনের মিষ্টি সম্পর্কটা ভীষণ ভালো লেগেছে। এই বই পড়ে একটা তৃতীয় চোখ থেকে মানুষকে বুঝতে শিখেছি। শেষে দুর্গা যখন মারা যায়, সেই অংশটা পড়তে গিয়ে কেঁদেছি বারবার।

স্টিফেন কিংয়ের দ্য শাইনিং আরেকটি ভালো লাগার বই। হরর, রহস্যের দুনিয়ায় কিংই তো ‘রাজা’! এই বইয়ের মাধ্যমে একজন অনবদ্য লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার পরিচিত সবাই জানেন, আমি যদি দুইটা বই কিনি, তার মধ্যে একটা হবে কিংয়ের।