Thank you for trying Sticky AMP!!

তুষাণের দাবা

>

প্রযুক্তিকর্মী তুষাণ গোলাম মোর্শেদ শখের দাবাড়ু। তাঁর সংগ্রহে আছে দেশি–বিদেশি চমৎকার কিছুর দাবা–সেট। বাংলাদেশি একটি দাবা–সেটও বানিয়েছেন এ তরুণ।

তুষাণ গোলাম মোর্শেদের বয়স তখন ১০–১১ বছর। ১৯৯৪–৯৫ সালের কথা। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়েন চতুর্থ কিংবা পঞ্চম শ্রেণিতে। ঢাকায় এসে ঘুরতে গেছেন জাতীয় জাদুঘরে। প্রাচীন সব জিনিস দেখতে দেখতে শ্বেতপাথরের একটা দাবা–সেটে তাঁর চোখ আটকে গেল। মনটাও আটকে গেল সেই থেকে।

পাট দিয়ে নিজের বানানো দাবা–সেটের সঙ্গে তুষাণ গোলাম মোর্শেদ। ছবি: খালেদ সরকার

১৪ নভেম্বর ঢাকার বারিধারায় তখন বিকেল হব হব করছে। সবুজে ঘেরা পার্ক রোডের এক মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সাদা রঙের একটা বাসা। সেখানে তিনতলার বসার ঘরে একটা বারান্দা। মাঝে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল। সেটা ভেদ করে রোদের আলো মেঝেতে অলস শুয়ে আছে। কিন্তু বেশ যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে রাজা, মন্ত্রী আর হাতি–ঘোড়ার দল। বড়সড় এক দাবার সেট। এটা তুষাণের সংগ্রহশালার অংশ। অনেক দিন আগে জাদুঘরে নজরকাড়া দাবা–সেটটির কথা বলছিলেন তিনি, ‘ছোটবেলা থেকেই দাবায় আগ্রহ ছিল। জাদুঘরে মহারাজার ওই সেটটা দেখার পর চোখ জুড়িয়ে গেল। তখন বুঝলাম, রাজা ঘুঁটিটা রাজার মতো, হাতি ঘুঁটিটা ঠিক হাতির মতোও হতে পারে! মনে মনে সেটটা নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।’

তুষাণের সংগ্রহের মধ্যে দুবাইয়ের এই দাবা–সেটটিই সবচেয়ে দামি

মহারাজ, একি সাজে...

মনের মতো রাজা কি চাইলেই মেলে? তুষাণ খুব ছেলেবেলায় উত্তরটা জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও মহারাজ ‘হৃদয়পুরমাঝে’ টোকা দিয়ে গেল বেশ কটা বছর। অবশেষে ২০১৬ সালে আবার দেখা মিলল মহারাজার সঙ্গে। এই সাক্ষাৎপর্বের স্থান কলকাতার একটি অ্যান্টিক শপ। তুষাণ তত দিনে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেছেন। প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানেই (এখন তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষকও)। সহকর্মীদের সঙ্গে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন রথযাত্রা দেখতে। রথ দেখতে গিয়ে কলা বেচার কোনো কারণ নেই। দাবা–সেট কেনার একটা সম্ভাবনা অবশ্য দেখা গেল। তুষাণ বলছিলেন, ‘ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে কলকাতায় কেনাকাটা করে পকেট খালি করে ফেলেছি। ফেরার আগের রাতে সিনিয়র এক সহকর্মী ওই দোকানটায় নিয়ে গেলেন। হঠাৎ একটা ছোট দাবা–সেট চোখে পড়ল। আমার আগ্রহের কথা শুনে দোকানদাররা দোতলায় নিয়ে গেলেন। সেখানেই দেখলাম, মহারাজা সেটটা, যেটা অনেকটা ছেলেবেলায় দেখা ওই সেটটার মতো। ওটা ছিল শ্বেতপাথরের, এটা কাঠের। কিন্তু নকশা প্রায় একই রকম। ঠিক করলাম, যে করেই হোক এই সেটটা আমার পেতে হবে।’

অতঃপর সহকর্মীর কাছ থেকে ধার করে প্রায় ১০ হাজার রুপি দিয়ে মহারাজাকে নিজের করে নিলেন তুষাণ। ব্যাপারটা যেন ‘আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম’।

ইংল্যান্ডের ব্যাটল অব ওয়াটারলু দাবা–সেট

প্রাণের টানে

ছেলেবেলায় দাবায় পেয়ে বসেছিল তুষাণকে। সাদা–কালো দাবার বোর্ড তাঁর শৈশব–কৈশোর রাঙিয়ে দিয়েছিল। স্কুলের ক্লাসে তাঁকে পাওয়া না গেলে সবাই বুঝে নিত তিনি কোথায় ডুবে আছেন। কমনরুমে দাবার দুটি বোর্ড ছিল। সেখানেই দেখা মিলত তাঁর। তুষাণের ভাষায়, ‘খেলা শেষ না হলে কোত্থাও নড়তাম না। আগে খেলা শেষ হবে, তারপর অন্য কিছু। সে সময় কাঠের তৈরি একটা দাবা–সেট কিনেছিলাম ঢাকার গুলশান থেকে। সাধারণ সেটই ছিল সেটা, কিন্তু কাঠের হওয়ায় একটু আলাদা ছিল। সবাই দেখে খুব প্রশংসা করল।’

সেই প্রশংসাই তুষাণ নিলেন শখের অনুপ্রেরণা হিসেবে। দাবা–সেট নিয়ে শুরু করলেন ঘাঁটাঘাঁটি। কলেজ শেষ করে ঢাকায় এলেন। ঐতিহ্যবাহী দাবা–সেট নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একদিন চীনের টেরাকোটা আর্মি থিমের একটা দাবা–সেটের (রেপ্লিকা) খোঁজ পেলেন নিলামের অনলাইন সাইট ইবে–তে। চীনের প্রথম সম্রাট চিন শি হুয়াংয়ের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাবাহিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল টেরাকোটা দিয়ে। মূর্তিগুলো সম্রাটের সমাধির সঙ্গে অর্থাৎ মাটির নিচেই ছিল। ১৯৪৭ সালে চীনের সানজি প্রদেশে সেসব খুঁজে পান স্থানীয় কৃষকেরা। তারপর থেকে চীনের বহু মাধ্যমে টেরাকোটা আর্মি থিম ব্যবহারের প্রচলন হয়। তার মধ্যে দাবা–সেটও বাদ যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই তুষাণ ওই সেটটার খোঁজ পেয়ে রীতিমতো শিহরিত। ইবে–তে কেনার ফরমাশ দেওয়ার পর শুরু হলো অপেক্ষার প্রহর গোনা। বলছিলেন, ‘একটা মাস যে কী করে কাটল, বোঝাতে পারব না! হাতে পাওয়ার পর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সে যে কী আনন্দ!’

তুষাণের সংগ্রহে এ রকম ছোট দাবার বোর্ড ও ঘুঁটিও আছে

একেই বলে কিস্তিমাত

সেই থেকে তুষাণ আরও আনন্দ (পড়ুন দাবা–সেট) সংগ্রহে উঠেপড়ে লাগলেন। ‘আপনার সংগ্রহে সবচেয়ে দামি সেটা কোনটি?’—প্রশ্নটি করার পর তুষাণ হাসলেন। দাবা খেলায় ‘ক্যাসলিং’ বলে একটি শব্দ আছে। বিশেষ শর্তে রাজা একবার ঘর বদল করতে পারে। তুষাণ সেই ক্যাসলিং করে পাশের ঘরে গেলেন। তেরছা করে মাথা কাটা সিলিন্ডারের মতো কতগুলো ঘুঁটিতে সাজানো কালো রঙের একটা বোর্ড দেখিয়ে বললেন, ‘এটা দুবাইয়ের একটা সেট। স্পেশাল এডিশন, বাজারে পাবেন না।’

কীভাবে পেলেন? তুষাণের মুখে রহস্যের হাসি, ‘একদিন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর জানতে পারি, তাঁর কাছে কিছু দাবা–সেট আছে। সেখানে এই সেটটা দেখার পর অনেক খোঁজখবর নিয়ে বুঝলাম, এই সেট বাজারে নেই, মানে দামি। কিন্তু সেটটা ওই ভদ্রলোক দুবাইয়ে পড়ার সময় পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন। এসব জানার পরও সেটটা পাওয়ার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতে থাকল। পরে অনেক বুঝিয়ে–সুঝিয়ে সেটটা কিনেও নিলাম ২০ হাজার টাকা দিয়ে।’

এই সেটটি তৈরি করা হয়েছে চীনের টেরাকোটা আর্মি থিমে

শ্যামলবরন কোমল মূর্তি

দেশি তো আছেই, তুষাণের সংগ্রহে বিদেশি দাবা–সেট আছে ২৫টিরও বেশি। থাইল্যান্ডের মাখরুখ, ইংল্যান্ডের ব্যাটল অব ওয়াটারলু, ভারতের শ্বেতপাথরেরসহ চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেপালের হাতে বানানো দাবা–সেট তাঁর শোকেস সমৃদ্ধ করেছে। তাই তুষাণের আফসোস, ‘প্রায় সব দেশেই ঐতিহ্যবাহী দাবা–সেট আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কোনো সেট নেই। দেশের বাইরের কাউকে বলতে পারি না যে এটা আমাদের তৈরি।’

তবে আফসোসের পাল্টা চালও তৈরি করে ফেলেছেন তুষাণ নিজেই। পাটের তৈরি গ্রামীণ পুতুল দিয়েই বানিয়েছেন দাবার ঘুঁটি। শ্যামলবরন কোমল মূর্তিগুলোর গায়ে পরিয়েছেন রঙিন শাড়ি। আর বোর্ড বানাতে বেছে নিয়েছেন ব্লক প্রিন্টের নকশা আঁকা কাপড়। তুষাণের স্বপ্ন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে এই দাবা–সেটটা বানিয়েছি। যান্ত্রিক এই সময়ে তরুণ প্রজন্মকে আমি দাবার মতো সৃজনশীল একটা খেলায় আগ্রহী করে তুলতে চাই। এ জন্য আমরা চারজন দাবা–সেট সংগ্রাহক মিলে কদিন আগে একটা প্রদর্শনীও করেছি। আমার এই দাবা–সেটটি সেটিরই অংশ। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে এমন একটা দাবা–সেট হলে কী দারুণ হবে, ভাবুন!’