Thank you for trying Sticky AMP!!

তেঁতুলিয়ার স্কুল থেকে জাতীয় দলে

তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজের হ্যান্ডবল খেলোয়াড়েরা l ছবি: প্রথম আলো

কয়েকজন মেয়ের নাম-পরিচয় বলি। শিরিনা আকতার বাংলাদেশ জাতীয় হ্যান্ডবল দলের অধিনায়ক, শাহিদা আকতার জাতীয় হ্যান্ডবল দলের কোচ, শাহানাজ আকতার বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের সাবেক অধিনায়ক আর ফারজানা আকতার সাফ গেমসে তায়কোয়ান্দোতে স্বর্ণপদক জয়ী। এই কজন নারী ক্রীড়াবিদ পড়াশোনা করেছেন বা করছেন এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর সেটি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজ।

শুরুতেই যে কজনের নাম বলা হলো, তাঁরা ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানে আরও প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী এখন খেলছে হ্যান্ডবল, ভলিবল আর কাবাডি। জাতীয় দল, বিজিএমসি আর আনসারের খেলোয়াড় তারা।

বিদ্যালয়টি জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবলে আটবার চ্যাম্পিয়ন ও চারবার রানার্সআপ হয়েছে। ভলিবলে দুবার চ্যাম্পিয়ন ও তিনবার রানার্সআপ। এভাবেই যেন নারী খেলোয়াড় তৈরির এক দারুণ কারখানায় পরিণত হয়েছে কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজ।

এই নারী খেলোয়াড়দের প্রায় সবাই অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তারপরও সামাজিক, অর্থনৈতিক বাধা পেরিয়ে তেঁতুলিয়ার এই নারীরা আজ জাতীয় স্তরের ক্রীড়ায় অবদান রাখছেন।

৪ নভেম্বর দুপুরে ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে। তিনটায় পরীক্ষা শেষ হলে যে যার মতো চলে যায় বাড়িতে। চারটার মধ্যে আবার স্কুলমাঠে চলে আসে অনুশীলনের জন্য। আমবাগানের মাঠে শুরু হয় ভলিবলের অনুশীলন। সেদিন সেখানে ভলিবল খেলছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী মাহমুদা আকতার, পারভীন আকতার, নবম শ্রেণির সানিয়া আকতার, লিলি বেগম, সপ্তম শ্রেণির উর্মি ও তানিয়া।

স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী শিরিনা আকতারও ছিলেন সেখানে। তিনি বললেন, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের খেলায় দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। আমার সেই দৌড় দেখেছিলেন তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন স্কুলের শরীরচর্চা শিক্ষক আবুল হোসেন। তিনি আমাকে জোর করে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমাকে ভলিবল আর হ্যান্ডবলের প্রশিক্ষণ দেন।’ শিরিনা আকতার ২০০৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে তিনবার তাঁদের স্কুল হ্যান্ডবলে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১০ সাল থেকে শিরিনা বিজিএমসির হয়ে খেলছেন।

কথা হয় শাহিনা আকতারের সঙ্গে। তিনি কাজী শাহাবুদ্দিন স্কুল ও কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এখন বিজিএমসির হয়ে খেলছেন। তেঁতুলিয়ার আজিজনগরে বাড়ি। তাঁর বাবা জুলহাস আলী একজন বর্গাচাষি। বললেন, ‘একরকম জোর করেই আবুল স্যার এই স্কুলে আমাকে নিয়ে আসেন।’ আগে শাহিনা পড়তেন কালান্দিগঞ্জ স্কুলে। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ শাহিনা বলতে থাকেন, ‘অনেক বাধা ছিল। বাবা বলতেন, এসব খেলাধুলা ছেলেদের, মেয়েদের নয়। অনেক সময় স্কুলে বা অনুশীলনে আসা-যাওয়ার ভাড়াও পেতাম না। তখন আবুল স্যার ভাড়া দিতেন, নাশতা খাওয়ার টাকা দিতেন।’

দশম শ্রেণির ছাত্রী মাহমুদা আকতারের বাবা মফিজুল ইসলামও একজন বর্গাচাষি। অভাব-অনটনের সংসার। এই স্কুলে এসে মাহমুদা হয়েছে খেলোয়াড়। হ্যান্ডবল, ভলিবল, কাবাডি, ফুটবল—সবই খেলতে পারে মাহমুদা। সে বলে, ‘ফুটবল খেলতেই বেশি  স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ফুটবলের জাতীয় দলে খেলতে চাই।’

খেলোয়াড় তৈরির পেছনের কারিগর

নারী খেলোয়াড় তৈরির কারখানা যদি হয় তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজ, তবে সেটার প্রধান কারিগর হলেন আবুল হোসেন। ১৯৮৩ সালে স্কুলে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাস করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ভালো লাগেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে ভর্তি হয়েছিলেন। ফুটবল, হ্যান্ডবল, ভলিবল—খেলাকেই ভালোবাসতেন আবুল হোসেন। পড়াশোনা আর শেষ করা হয়নি। এরপর ১৯৮৩ সাল থেকে আছেন এই স্কুলে। আর গড়ে তুলছেন জাতীয় পর্যায়ের নারী ক্রীড়াবিদ।

অনুশীলনের মাঠে দাঁড়িয়ে আবুল হোসেন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ফুটবল, হ্যান্ডবল, ভলিবল খেলতাম। স্কুলে যোগ দিয়েই মেয়েদের খেলাধুলার প্রতি মনোযোগী করার কাজ শুরু করি। হ্যান্ডবল দল গঠন করে দিই।’ এভাবেই এগিয়ে চলেন আবুল হোসেন। তিনি জানান, তেঁতুলিয়ার মেয়েদের খেলোয়াড় তৈরিতে অনেকের অবদান আছে। সেই সময়ে বিজিবিতে কর্মরত আবুল কালাম আজাদ ও হায়দার আলী বাড়িতে এলে মেয়েদের সঙ্গে হ্যান্ডবল খেলতেন। আবুল হোসেনও শিখে নিয়ে মেয়েদের সেসব অনুশীলন করাতেন। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি, স্থানীয় মানুষ আর কাজী পরিবার নারী খেলোয়াড় তৈরির ব্যাপারে সব সময় সহযোগিতা করেছে আবুল হোসেনকে।

নিজেদের উদ্যোগে আর চেষ্টায় কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল ও কলেজের ছাত্রীরা ক্রীড়াঙ্গন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষÿইমদাদুল হক বললেন, ‘আরও সহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তেঁতুলিয়া থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নারী খেলোয়াড় বের করা সম্ভব হবে।’