তোমার জন্য
ঠিক এক বছর আগে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটা ছবির কথা মনে পড়ে গেল। মোহাম্মদপুরের বছিলায় তোলা সেই ছবিতে দেখা যায়, শ্রমিক মানসুরা বেগমের মাথায় পাথরবোঝাই ভারী ঝাঁকা তুলে দিতে সাহায্য করছেন আরেক দিনমজুর কামাল হোসেন।
এবার চোখ ফেরাই এই প্রতিবেদনের ছবিগুলোতে। মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া এবং তাঁর স্বামী ফারুক হাসান আয়েশ করে চা পান করছেন। ঘরের টুকটাক জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন। দেখার বিষয় হলো চা বানিয়ে দিচ্ছেন ফারুক হাসান, জিনিসপত্র গোছানোর বেলায়ও তিনি প্রধান ভূমিকায়। ঘরের কাজ নারীদের, বাইরের কাজ পুরুষদের। পুরুষ তো ‘ব্রেড আর্নার’! ঘরের কাজ তিনি কেন করবেন? আমাদের সমাজের গৎবাঁধা এই যে ভাবনা, তার পরিবর্তন তো দরকার। একটু একটু করে তা হচ্ছেও। সংসারের ‘ব্রেড’ এখন নারীও জোগান দেন।
পিয়া যেমন বললেন, ‘সংসারের জন্য যেটা দরকার সেটা দিতে পারলেই হয়। ফারুক যেমন আমাকে বাজারে নিয়ে যায়, দরকার হলে আনা-নেওয়া করে। আমি নিজেও রোজগার করি। খরচ করি সংসারের জন্য। ধরুন আমি ঘর পরিস্কার করব। ওকে বললে সে হয়তো ঘর পরিস্কারের ঝাড়ুটা বাজার থেকে কিনে এনে দিতে পারবে। আর তাছাড়া আজকাল নানা যন্ত্রপািত পাওয়া যায় সেগুলো ছেলেমেয়ে যে কেউ ঘর পরিস্কারের কাজ করতে পারে। ভাগ করে সেটাও করা যায়।’ এভাবেই দুজন দুজনকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতে পারেন। সেটাই জরুরি বলে মনে করেন পিয়া। তাঁর মতে, এর থেকেও বড় যে বিষয়, সেটি মানসিক সমর্থন। স্বামীরা যে কাজটা চাইলে সহজেই করতে পারেন।
ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের কথা একটু বলতেই হয়। মার্ক ও প্রিসিলা চ্যান দম্পতির কন্যাসন্তান ম্যাক্সের জন্ম হলো। ফেসবুক থেকে মার্ক দুই মাসের ছুটি নিলেন। ম্যাক্সের ডায়াপার পাল্টানো, টিকা দিতে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া—মার্ক ব্যাপক তৎপর। তাঁর হাসিমুখ, কন্যার সঙ্গে সেসব ছবি ফেসবুকে বেশ গর্বের সঙ্গে দেন। আর আমরাও মুগ্ধ হই সেসব দেখে, মার্কের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছি নিজের সন্তান জন্মানোর পর এসব কাজ আমরা কি করেছি? নাকি এগুলো তো মায়ের কাজ বলে তাঁর একার ওপর চাপিয়ে দিয়েছি? বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে বাবা হওয়ার গর্বে গদগদ হয়ে সন্তানকে আলতো করে কোলে নিয়ে গবেষণা করে বের করেছি ‘ওর চেহারার ধাঁচটা তো আমার মতো!’ আপনি-আমি আমরা পুরুষেরা উত্তরটা কমবেশি জানি।
বেশ কয়েক বছর হলো দেখছি ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের অফিসসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগ থেকে নারী কর্মীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। কখনো থাকে শুভেচ্ছা কার্ডও। নারীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ। তাঁকে সহকর্মী হিসেবে সম্মান দেওয়া। আমরাও আছি আপনাদের সঙ্গে—এই অনুভবটা তাঁদের দেওয়ার একটা প্রতীকী প্রকাশ। করপোরেট কোচের প্রধান পরামর্শক যিশু তরফদার বললেন, ‘প্রতীকী হিসেবে দিনটা আমরা পালন করে থাকি। তবে নারীকে প্রতিদিনই সম্মান করা উচিত। মূল বিষয়টা হলো, মানুষের জন্য মানুষের সম্মান দেখানো। এভাবে বুঝতে পারলে “জেন্ডার বায়াসড” বিষয়টি কমে আসবে।’
নারী দিবস ঘিরে যে আয়োজন, নারীর প্রতি সম্মান-স্নেহ-ভালোবাসা-সহমর্মিতার যে প্রতীকী প্রকাশ, তা আসলে সচেতনতা তৈরি করে। যিশু তরফদার যেমন মনে করেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের উচিত কর্মক্ষেত্রটিকে নারীবান্ধব করে তোলা। দেশের আইন মেনে নারীর প্রাপ্য সব সুবিধা দেওয়া। নারী কর্মীর শিশু সন্তান থাকলে তার জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেই থাকা উচিত।
কয়েক দিন আগে এক সভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন এমন একজন, যিনি মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি জানালেন এক তথ্য—জন্মগতভাবেই নাকি পুরুষের চেয়ে নারীর বুদ্ধি ১০ আউন্স কম! যিশু তরফদার একে বলছেন অনগ্রসর সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের কথাই বলি, ঘরে-বাইরে কোথায় নেই নারী! ক্রিকেট মাঠ থেকে শুরু করে এভারেস্ট চূড়া; শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য থেকে শুরু করে রণক্ষেত্র, রাজনীতি—নারী তো তাঁর মেধা, দক্ষতার প্রমাণ সমানে দেখিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও আমার-আপনার সহকর্মী মেয়েটি বা নারী যদি পদোন্নতি পেয়ে যান, তবে তার ‘গূঢ় কারণ’ খুঁজতে থাকি আমরা। আবার এও শোনা যায়, ‘তুমি নারী বসের সঙ্গে কীভাবে কাজ করো।’ অথচ আমাদের আশপাশেই অনেক উদাহরণ আছে বছরের পর বছর নারী বস তাঁর অফিস কিংবা বিভাগ ঠিক ঠিক চালাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে যে পুরুষ কর্মীরা আছেন, তাঁরাও তাঁকে যথাযথ সম্মান করছেন। যিশু তরফদার এ ব্যাপারে বলেন, ‘সাংস্কৃতিক যে অসচেতনতা এখনো আছে, তার কারণে উদ্ভট নেতিবাচক এই মানসিকতা। বৈজ্ঞানিকভাবেই সত্য নারী ও পুরুষের মেধা সমান। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীকে নেতা হিসেবেই দেখতে হবে। আবার নারী বসকেও তাঁর কর্মীদের প্রতি পেশাদার মনোভাব দেখাতে হবে।’
নারী আর পুরুষের জন্য পোশাক-আশাকের রংও কী করে জানি নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ধারায় অবশ্য ইদানীং পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। নারী দিবসে দেখা যায় নানা নকশায়, পরনের পোশাকে পার্পল বা হালকা বেগুনি রং। এই রং কি পুরুষেরা পরতে পারেন না? ফ্যাশন হাউস বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা গত বছর নারী দিবসের একটা টিভি অনুষ্ঠানে পার্পল রঙের পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলেন। ‘আমি সংহতি প্রকাশ করতে চেয়েছি। আর এখন দেখা যাচ্ছে পার্পল বা গোলাপি রংগুলো ট্রেন্ডি হয়ে উঠছে। বাইরের দেশে তো এসব রঙের স্যুটও দেখা যায় অনেক পুরুষকে পরতে।’
কিছু কিছু ফ্যাশন হাউস নারী দিবস উপলক্ষে পোশাক বাজারে আনে। দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নারী কর্মীদের জন্য এসব পোশাক কিনে নেয়। অনেকে মনে করতে পারেন এক দিন শুধু সম্মান দেখিয়ে বা উদ্যাপন করলেই কি দিবসটির মূল চেতনার বিকাশ ঘটে? বিপ্লব সাহার সাফ জবাব, ‘এক দিন এক দিন করেই তো অনেক দিন হয়। একটা উপলক্ষ ধরে সূচনাটা হয়। নারী দিবস এক দিনের আমি তা মনে করি না। তবে এই এক দিনের উদ্যাপন সচেতনতা তৈরি করবে ভবিষ্যতের প্রতিদিনের জন্য।’
ঘরের কাজ নারীর, বাইরের কাজ পুরুষের—এ ধারণার কফিনে পেরেক ঠোকার সময় এসে গেছে। কারণ, বাস্তবতা হচ্ছে সমাজের উঁচু স্তর থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনপদ পর্যন্ত নারী এখন আয়েরও অংশীদার। তারপরও বাইরের কাজ সামলে ঘরের কাজও তাঁকে একা সামলাতে হবে?
গত বছর নারী দিবসে পত্রিকায় একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, ‘আমি নারী সব পারি।’ সাধারণভাবে যেসব জায়গায় আমরা নারীর কাজে সহায়ক হই না কিংবা হতে চাই না, সেসবে সহযোগিতা করে আমরাও তো গর্ব নিয়ে বলতে পারি, ‘আমি পুরুষ সব পারি’। আর সেই শুরুটা তো আজ ৮ মার্চ থেকেই হতে পারে।