Thank you for trying Sticky AMP!!

দাবদাহে বেড়েছে কাজ, কমেছে স্বস্তি

প্রচণ্ড গরমে কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকিমহালে কাজ করছে শিশুরা। ছবিটি ২২ মে দুপুরে তোলা l প্রথম আলো

মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। পায়ের নিচে তেতে ওঠা বালি। ভ্যাঁপসা গরমে ঘামতে ঘামতে শ্রমিকদের কেউ কাঁচা মাছ বাছাই করছেন, আবার কেউ মাছে লবণ দিয়ে সেসব বাঁশের মাচায় তুলে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। কক্সবাজারের নাজিরারটেক এলাকার একটি শুঁটকি মহালে পুরুষদের পাশাপাশি প্রায় ৩০ জন নারী ও শিশু শ্রমিক কাজ করছিলেন। এই গরমে তাঁদের কাজ মিললেও স্বস্তি মেলেনি।

২২ মে দুপুরে শহরের সৈকতসংলগ্ন নাজিরারটেক এলাকায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। এখানকার ৩০টির মতো শুঁটকির মহাল ঘুরে একই দৃশ্য দেখা গেছে। এখানে এখন পুরোদমে চলছে শুঁটকি তৈরি। ৩৫-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শুঁটকিও তৈরি হচ্ছে দ্রুত। তবে এমন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন নারী ও শিশু শ্রমিকেরা। এখানকার বিভিন্ন মহালের শ্রমিকেরা জানান, গত এক সপ্তাহে কাজ করতে গিয়ে অন্তত ৫০ জন নারী ও শিশু শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তীব্র খরতাপে মূর্ছাও গেছে অন্তত সাতজন শিশু।

শুঁটকি মহালের মালিক ও শ্রমিকেরা জানান, কাঁচা মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করতে আগে সময় লাগত দুই থেকে তিন দিন। আর এখন সময় লাগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও এমন আবহাওয়াই শুঁটকি তৈরির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এ কারণে কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে শুঁটকি তৈরির ধুম লেগেছে। এ সুযোগে কাজ পাচ্ছে হতদরিদ্র লোকজন। এদের মধ্যে আছে নারী ও শিশু শ্রমিকেরাও। দৈনিক আট থেকে দশ ঘণ্টা পুরুষের সমান কাজ করলেও নারীরা পান পুরুষের অর্ধেক, ২০০ টাকা মজুরি। আর শিশুরা পায় আরও কম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় শুঁটকি তৈরি অনেক বেড়েছে। এতে লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নারী ও শিশু শ্রমিকেরা প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের দেখার কেউ নেই।

নাজিরারটেকের মতোই কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া ও ফদনারডেইল এলাকার শুঁটকি মহালগুলোতে একই পরিবেশে কাজ করছে নারী ও শিশু শ্রমিকেরা। পুরো কক্সবাজারের শুঁটকিপল্লিগুলোতে ঠিক কত সংখ্যক নারী ও শিশু শ্রমিক কাজ করে, তা জানা যায়নি। তবে স্থানীয় পৌরসভা কাউন্সিলর আকতার কামালের মতে, এই সংখ্যা আট হাজারের মতো হবে। তিনি বলেন, শহরের নাজিরারটেক উপকূলে শতাধিক শুঁটকিমহালে শ্রমিক আছেন প্রায় ১২ হাজার। এর মধ্যে ৫ হাজার নারী ও ৩ হাজার শিশু শ্রমিক। কম টাকায় কাজ আদায়ের জন্য মহালের মালিকেরা নারী ও শিশুদের নিয়োগ দেন বেশি।

মহালগুলোতে শ্রমিকেরা ছুরি, লইট্যা, কোরাল, চাপা, কাহিলা, মাইট্যা, ফাইস্যা, চিংড়ি, পোপা, রাঙাচকি, গুইজ্যাসহ নানা ধরনের মাছের শুঁটকি তৈরি করছেন। ব্যবসায়ীরা মহাল থেকে শুঁটকি কিনে ট্রাক বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছেন।

মর্জিনা আকতার (৪৫) নামের একজন শুঁটকিশ্রমিক বলেন, সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করে পাওয়া যায় ২০০ টাকা। অথচ সমান কাজ করে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পান ৪০০ টাকা। ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিতেই তীব্র দাবদাহে এত কম টাকায় কাজ করতে হচ্ছে।

আরেকটি শুঁটকিমহালে পুরুষের পাশাপাশি ১০-১২ জন শিশু-কিশোরকে শুঁটকি তৈরি করতে দেখা গেছে। তাদেরই একজন মো. মানিক (১২) জানায়, তিন বছর আগে তার বাবা অন্য এক নারীকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। এ কারণে তাকে শুঁটকিমহালে কাজ করতে হচ্ছে। কাজ না করলে মা ও চার ভাইবোনকে না খেয়ে থাকতে হয়।

আরেক শিশু শ্রমিক রোকেয়া বেগম (১৩) বলে, বাবার মৃত্যুর পর পড়ালেখা বাদ দিয়ে শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে তাকে। কয়েক দিন আগে প্রচণ্ড গরমে বাঁশের মাচায় শুঁটকি মাছ রাখতে গিয়ে একবার মূর্ছা গিয়েছিল সে। তীব্র দাবদাহে সব সময় মাথা ঘুরে। কিন্তু করার কিছু নেই। কাজ না করলে টাকা মিলবে না।

তবে মহালে শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন মালিকেরা। নাজিরারটেক এলাকার একটি মহালের মালিক সাব্বির আহমদ বলেন, ‘আমাদের মহালে শিশু শ্রমিকেরা কাজ করে না। তীব্র দাবদাহ কাজে লাগিয়ে উপকূলে শুঁটকি উৎপাদন চলছে। তাতে শ্রমিকদের কষ্ট হলেও কাজ পাওয়ায় সবাই খুশি।’ বর্তমানে প্রতি কেজি শুঁটকি রকম ভেদে ২০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, পর্যটন মৌসুমের ছয় মাসে (নভেম্বর-এপ্রিল) শহরে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়। এসব শুঁটকি এখন বাইরে রপ্তানিও হচ্ছে। গত বছর মহালে উৎপাদিত পোপা শুঁটকি হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি করে পাওয়া গেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।