Thank you for trying Sticky AMP!!

নারীর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা

>

রওনক জাহান

নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু তারপরও দেশে নারী নির্যাতন হয়ে চলেছে। এ ব্যাপারে প্রথম আলো কথা বলেছে জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রওনক জাহান-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুসলিমা জাহান

প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও দেশে নারী নির্যাতন হচ্ছে দেশে বর্তমানে ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

রওনক জাহান: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রাথমিকভাবে এই পরিসংখ্যানটি উদ্বেগজনক হলেও একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি এর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সম্মিলিত কর্ম উদ্যোগের ইতিবাচক চিত্র আছে বলে মনে করি। কারণ, বিবাহিত নারীর প্রতি স্বামী কর্তৃক সহিংসতা-সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের রিপোর্টে এ সহিংসতার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে কমে হয়েছে ৮০ শতাংশ। আবার আমরা দেখি পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা-বিষয়ক মামলা রুজুর হার বেড়ে চলেছে। যেমন: ২০১০ সালে সারা দেশে এ বিষয়ক মামলা রুজু হয়েছিল মোট ১৭ হাজার ৭৫২টি, সেখানে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২২০টি। এই দুটি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে একদিকে নারীর প্রতি সহিংসতার হার কমছে, আবার এ ধরনের সহিংস ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

প্রথম আলো: নারী নির্যাতনের মামলার হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কি আপনি কীভাবে দেখছেন?

রওনক জাহান: আমার মতে, নারীর প্রতি সহিংসতা-বিষয়ক মামলা বৃদ্ধির ব্যাপারটি একটি বিষয় স্পষ্ট করে তুলেছে যে নারীরা এখন নির্যাতনের ব্যাপারে নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে আসছে। আগে যেমন স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের বিষয়টিকে সমাজের চোখে, অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার নারীর চোখেও স্বাভাবিক বা ভাগ্যের ফের বলে মনে করা হতো, কোনো অভিযোগ করা হতো না—এখন আর তা কিন্তু হচ্ছে না। আরও একটি বিষয়কে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তা হলো, নারীর প্রতি সহিংসতার সংজ্ঞাগত পরিবর্তন। আগে যেমন কেবল শারীরিক নির্যাতনকেই সহিংসতা বলে মনে করা হতো, ২০১০ সালে প্রণীত পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী এখন মানসিক বা আবেগগত নির্যাতনকেও নারীর প্রতি সহিংসতা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ে আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়েছি।

প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ঠিক কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে?

রওনক জাহান: আমি মনে করি, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হলে নারী সম্পর্কে চিরাচরিত ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে, নারী নেতৃত্বের উদাহরণ তৈরি করতে হবে, যা নারীর প্রতি সমাজের তথাকথিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনবে। জেন্ডারবৈষম্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হলে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরির জন্য শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিক্ষা উপকরণ, যেমন বইগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যা থেকে ছেলে বা মেয়ে কেউই কোনো একটি জেন্ডারের প্রতি পক্ষপাত নিয়ে বড় হতে না পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, বাবা-মাকে পরিবারের মধ্যে এমন সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যা দেখে সন্তানেরা বাবা-মায়ের সমঅধিকার, সমান দায়িত্ব, বিষয়গুলো দেখবে ও শিখবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। আমি আরও মনে করি যে সব পেশার মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ভূমিকা রয়েছে। পেশাগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা—দুটো বিষয়কেই গুরুত্ব দিয়ে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়টিকে কেবল নিছক অপরাধ বা আইনি দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করলে ভিকটিমকে ন্যায়বিচার দেওয়া সম্ভব হয় না, যা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

্রথম আলো: বিষয়টা কি একটু ব্যাখ্যা করবেন?

রওনক জাহান: যেমন, সাম্প্রতিককালে ধর্ষিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তারা ধর্ষিত হওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবে্ নিগ্রহের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ধর্ষণের শিকার শিশুরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। স্কুলের সহপাঠীরা তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ, সমাজ তাকে বহিষ্কার করে দিচ্ছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সে-ই অপরাধী। যেখানে তাদের সবার সহমর্মিতা পাওয়ার কথা, সেখানে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই কেবল আইনি ব্যবস্থা নয়, এর বাইরেও পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেক দায়িত্ব রয়ে যায়, যা কেবল স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। এ ছাড়া নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নারীরা নির্বিঘ্নে সহিংস ঘটনার প্রতিকার চাইতে পারে।

প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা কীভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলে?

রওনক জাহান: নারীর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র—সবার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রথমত, সহিংসতার শিকার নারী জগৎ ও জীবনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করে। যে পরিবারে নারীরা সহিংসতার শিকার হন, সে পরিবারের শিশুরা অসুস্থ মানসিকতা ও জীবনবিমুখ হয়ে বেড়ে ওঠে। এ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের মাদকাসক্তি বা জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। এ ধরনের পরিবারের ছেলেশিশুদের মধ্যে পরবর্তী জীবনে নারীর প্রতি সহিংস আচরণের আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। যে সমাজ বা ব্যক্তি নারীকে তাঁর যথাযথ সম্মান বা মর্যাদা দিতে জানে না, সে সমাজের অর্ধেক অংশ শক্তিহীন হয়ে পড়ে বলে আমি মনে করি।

প্রথম আলো: জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে আপনার জেলায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

রওনক জাহান: ইউএনএপিএর কারিগ​ির সহায়তায় জামালপুর জেলার তিনটি থানায় নারী সহায়তা কেন্দ্র (উইমেন হেল্প ডেস্ক) কাজ করছে। বাংলাদেশের ৪৪টি জেলার বিভিন্ন থানায় উইমেন হেল্প ডেস্ক চালু আছে, যেখানে নারীরা যে কোনো সমস্যার ব্যাপারে সহায়তার জন্য আসতে পারে। বাংলাদেশ পুলিশ এসব হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নির্যাতিত নারী ও মেয়েশিশুদের আইনি সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় রেফারেল এর ব্যবস্থা করছে। পারিবারিক সহিংসতা,শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এ সব বিষয় সংবেদনশীলতা ও মনোযোগ সহকারে শোনা হয়, প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার পাশপাশি কাউন্সেলিং করাসহ অন্যান্য সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ জেলার যেসব থানায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উইমেন হেল্প ডেস্ক চালু হয়নি সেখানে ইউএনএফিপএর সহায়তায় প্রস্তুতকৃত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এস ও পি) কে গাইডলাইন হিসেবে নিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটা সহজভাবে সব থানায় নারী ও শিশুদের সমস্যার বিষয়গুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় সে ব্যাপারে সহযোগিতা করছে। তবে যদি সব থানায় ইউমেন হেল্প ডেস্ক চালু করা হয়, তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের প্রচেষ্টা অনেক বেশি ফলপ্রসু হবে বলে আমি মনে করি। উইমেন হেল্প ডেস্ক প্রতিষ্ঠায় আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আমি ইউএনএফ​িপএ কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।