Thank you for trying Sticky AMP!!

নারীর মনের কষ্ট? সেটা আবার কষ্ট নাকি!

সন্তান প্রসবের পর রেজিনা আক্তারের আচার-আচরণ পরিবারের সবার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। তবুও পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বরং ভীষণ মন খারাপ করে বসে থাকা, কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতায় সবাই বিরক্ত ও বিব্রত ছিল। হঠাৎ করে টনক নড়ে যখন রেজিনা তার সদ্যোজাত সন্তানকে মেরে ফেলতে যায়।

প্রসব-পরবর্তী অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা সহজেই এড়ানো যেত, যদি রেজিনার অস্বাভাবিক এই মানসিক আচরণকে পরিবারের সদস্যরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। তাকে মানসিক চিকিৎসার আওতায় আনা হতো।

ভালো থাকার মানে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকা। কিন্তু মন এমন একটা ব্যাপার, যার নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা শুধু অনুভব করি কিন্তু সরাসরি দেখতে পাই না। আর দেখা যায় না বলে আমাদের মন সব সময় অবহেলিত। ফলে শরীরের সামান্য ব্যথায় বা কষ্টে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন হই এবং চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি, মনের মধ্যে ‘রক্তক্ষরণ’ হলেও যেন সেটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিই। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে  যদিও কিছুটা গুরুত্ব পায়, নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের দিক অত গুরুত্ব পায় না। তাদের মনের নানা উপসর্গে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে কুণ্ঠা বোধ করি।

শরীরের রোগে যেমন বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে, মনের সমস্যায়ও উপসর্গ নানাভাবে প্রকাশিত হতে পারে (অস্থিরতা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, অশান্তি, খিটখিটে মেজাজ, চিন্তা ও ব্যবহারে পরিবর্তন ইত্যাদি)। মনের কষ্ট সহজে অন্যের মনোযোগ পায় না বলে মানসিক সমস্যার একটি বড় অংশ শারীরিক উপসর্গ হিসেবে প্রকাশিত হয়।

শুধু তাই নয়, শারীরিক নির্যাতন বা আঘাত দেওয়াকে সমাজে যেমন গুরুতর ভাবে দেখি, মানসিক নির্যাতন করাকে আমরা এখনো তেমন খারাপভাবে দেখি না। তাই চেতন-অবচেতনে, কথার মাধ্যমে, আচার-ব্যবহারে প্রিয়জনের বা অন্য কারও মনে আঘাত দিই, ক্ষতবিক্ষত করি, সেটা আমলে আনি না। ধরা যাক, উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছে একটি মেয়ের। নিজেদের বাড়ি, আয়-রোজগারে কমতি নেই। কিন্তু মেয়েটি এসেছে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবার থেকে। তাই উঠতে-বসতে তাকে কথা শোনানো হয়। ‘ভালো কিছু তো খাওনি, রান্না শিখবে কোথা থেকে?’ কিংবা বাবার দেওয়া উপহারের দাম নিয়ে খোঁটা, ‘খুঁজে খুঁজে এর চেয়ে সস্তা কিছু পাওয়া গেল না?’...দিনের পর দিন এই খারাপ ব্যবহার সহ্য করা কঠিন। এই আঘাত তো চোখে দেখা যায় না! আবার একটা শিক্ষিত মেয়ে কর্মজীবী হতে চাইলে অনেক সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হয়, তোমার কিসের অভাব? শাড়ি, গয়না, সন্তানের লেখাপড়া সবই তো হচ্ছে? তাহলে কেন চাকরি করতে চাও? নাকি বাড়িতে মন টেকে না? এই মেয়েটি যখন দেখে তার সহপাঠীরা বিভিন্ন জায়গায় ভালো চাকরি করছে। সম্মান পাচ্ছে, নিজের মতো খরচ করছে তখন একধরনের হীনম্মন্যতা বোধ কুঁকড়ে খায় তাকে। কিন্তু কে রাখে তার মনের খবর? বর্তমান পারিপার্শ্বিক চাপ ছাড়াও একজন নারী মানসিক কষ্টে ভুগতে পারেন। কারণ যা-ই হোক না কেন, মানসিক কষ্টকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

মানসিক কষ্ট প্রকট হলে অনেক ক্ষেত্রে মানসিক রোগের চিকিৎসার প্রয়োজন বোধ করলেও সেখানে একপ্রকার লুকোচুরি ভাব চলে আসে। এই লুকোচুরির অন্যতম কারণ, মানসিক রোগ নিয়ে ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার। আর যদি হয় নারীর মানসিক রোগ, তবে তো পরিবারের সম্মান নিয়েই টানাটানি!

অনেক মানুষই মনে করেন, মানসিক সমস্যা মানেই হলো অস্বাভাবিক আচার-আচরণ অথবা ভূতের আছর। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ মানসিক রোগীর মধ্যে ১ শতাংশ জটিল মানসিক রোগে ভুগছে। বাকি ১৫ শতাংশ রোগী মৃদু মানসিক রোগে ভুগছে। এই মৃদু মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই নানা রকম উদ্বেগজনিত সমস্যা, বিষণ্নতা বা মানসিক চাপজনিত সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছে, যেখানে জটিল মানসিক রোগের কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

শরীরের মতো মনও আমাদের সত্তার একটি অংশ। মনের কষ্টকে উপেক্ষা করে শুধু শরীরের যত্ন করলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ ভালো থাকতে পারব না। নারী-পুরুষ সবার সার্বিক সুস্থতার অন্যতম শর্ত শরীর ও মনের যত্ন। কাজেই শরীরকে যেমন আমরা নানা আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখি, রোগ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিই, মনের কষ্ট লাঘবেও তেমনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অধিকাংশ পরিবারে নারীরা শরীরের কষ্টই চেপে রাখে, রোগ একেবারে শেষ পর্যায়ে না গেলে মুখ খোলে না। আর মনের কষ্ট? সেটা আবার কষ্ট নাকি?

লেখক: মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।