Thank you for trying Sticky AMP!!

নিজেকে ফিরে পেয়েছি

স্বপ্নগুলো দিনে দিনে কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। একসময় নিজেকে হারিয়েই ফেললাম। অন্ধকার দুনিয়াটা আমাকে গ্রাস করে নিল। শিশুসন্তান-পরিবার-পরিজন ভুলে কয়েকটা বছর ডুবে থাকলাম সেই অন্ধকার জগতে। অথচ কী সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ছিল আমার। স্বপ্নময় একটা জীবনের স্বাদ ছিল। একদিন যখন খেয়াল করলাম, বোধ ফিরে পেলাম—দেখি সবকিছু ধ্বংস করে ফেলেছি।
সে দিনগুলো করুণ, বারবার যেন ফিরে আসে। বিয়ের এক বছর পর ২০১০ সালে প্রথম মেয়েটা হলো। তখনো আমি নিজের ব্যবসা গোছাতে ব্যস্ত। আমার চারটা খাবারের দোকান রাজধানীর একটি বড় বিপণিবিতানে ভালোই চলছিল। তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে সদস্য হয়েছিলাম উইমেন চেম্বার অব কমার্সের। বড় বড় নারী উদ্যোক্তাকে দেখে স্বপ্ন দেখতাম তাঁদের মতো হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন কিছুদিনেই দুঃস্বপ্ন হয়ে নেমে এল। এত কিছুর পেছনে আমার সাবেক স্বামীর আচরণ, তাঁর মাদকাসক্ত জীবন। সে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। নিজ চোখে তাঁদের সে সম্পর্ক আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বারবার বলেও তাঁকে ফেরানো যায়নি। কষ্ট ভুলতে ২০১১ সালে আমিও জড়িয়ে পড়ি সেই জীবনে। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। তখন একটা মুহূর্ত আমি মাদক ছাড়া থাকতে পারতাম না।

মেয়ের বয়স তখন মাত্র এক বছর। মা হয়ে ওকে সময় দিতাম না। ২০১২ সালে ছেলের জন্ম হলো। ওদের খাওয়ানো–পরানো থেকে দেখভালের দায়িত্ব কিছুই আমি করতে পারতাম না। আমার মা সবকিছু করতেন। দিনে দিনে আমার ব্যবসা লাটে উঠল।

স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে ফেলি। তারও আগে পরিবার থেকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হলো আমাকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। বেশির ভাগ সময় ইয়াবা সেবন করতাম। ইয়াবার নেশা ছাড়তে চাইলে সহজে ছাড়া যায় না। এটা এমন একটি মাদক, যা ছেড়ে দিলে ঘুম ঘুম লাগে, নিজেকে শক্তিহীন মনে হয়। কোনো কিছুতে উদ্যম পাওয়া যায় না। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এ কারণে অনেকবার ছাড়তে চেয়েও ছাড়তে পারিনি। আবার মাদক নিতে বাধ্য হয়েছি।

২০১৪ সাল থেকে মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্র আপনগাঁওয়ে আসি। তারপর থেকে নিয়মিত এখানে এসে থাকি। এভাবে একসময় নিজেকে খুঁজে পাই। নিজেকে আবার ফিরে পাওয়ার পর আমি একটা কথা খুব বিশ্বাস করি। সেটা হচ্ছে, ইচ্ছা করলে যেকোনো নেশা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। ব্যক্তির নিজের ইচ্ছেশক্তিটা মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে খুবই জরুরি। এতে নিরাময়ের কাজটা সহজ হয়।

চিকিৎসকেরা মাদকের ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র বলে একটা বিষয়ের কথা বলেন। যেমন মাদক গ্রহণকারী বন্ধুদের দেখলে; যে জায়গায় মাদক নেওয়া হয়, সেখানে গেলে এবং যে সময় মাদক নেওয়া হয়, সে সময় এলে মাদকের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ বেড়ে যায়। ফলে এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। প্রিয়জনের কাছে থাকতে হবে। কারণ, সবার আগে প্রয়োজন ভালোবাসা। পরিবারের পক্ষ থেকে ভালোবাসার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব মাদক থেকে দূরে রাখা।

আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে সেই সহায়তা পেয়েছি। নিজের সমস্যার কথা গোপন করিনি। মাদকমুক্ত হতে হলে সবার আগে পরিবারকে জানাতে হবে। এখানে লজ্জার কিছু নেই। এটা একটা রোগ। অন্য কোনো রোগ হলে আমরা তো লুকিয়ে রাখি না।

এখনো আমি আপনগাঁওয়ে আছি। দুই মাস হলো। এখানে ভিন্ন পরিবেশ। পুনর্বাসনকেন্দ্রের বাইরে থাকলে ঝুঁকি থেকে যায়। এখন আমি খুব ভালো আছি।

আমার সবচেয়ে আনন্দের ঘটনাটি ঘটেছে গত বছর। আমার বোনের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো। গত বছর সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার একটি কিডনি বোনকে দান করব। নিজে কিছুই করতে পারিনি। পরিবারকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। সমাজের কাছে, মানুষের কাছে আমার মাদকাসক্ত জীবনের জন্য ওরা প্রতিনিয়ত খাটো হয়েছে। গত বছর ভারতের একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়। আমার ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভীষণ খুশি।

সুস্থ হওয়ার পর থেকে যতটা সম্ভব ছেলে-মেয়ে দুটোকে সময় দিই। যদিও ওরা আমার বোনের কাছে মানুষ হচ্ছে, দেখভাল সে–ই করে। এখন এই নিরাময়কেন্দ্রে বসেও খুব ইচ্ছা করে ওদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। কাছে থাকতে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি দূর দেশে চলে যাব। আমার পরিবারের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। সন্তানদের নিয়ে আমি চলে যাব। ওদের ভবিষ্যৎ আর নিজের বাকি জীবনটুকু আনন্দে কাটাতে চাই।

[লেখকের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।]