Thank you for trying Sticky AMP!!

পাথারিয়া রহস্য

পাথারিয়ার গভীরে এমন অসংখ্য ঝরনার দেখা মেলে

ভোরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পৌঁছে দেখি, ঘন কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে আছে প্রকৃতি। তখনো জানতাম না, সারা দিন কোমরপানিতে ডুবে থাকতে হবে। বড়লেখা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যখন কাঁঠালতলী বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম, তখনো চিন্তায় আসেনি, পরের দুটি দিন আমাদের শুধু জঙ্গলের ফল খেয়ে বেড়াতে হবে। পাথারিয়া বন বিভাগের বিট অফিসের বাংলোতে যখন নিজেদের ব্যাগ-বোঁচকা রেখে ট্র্যাকিং জুতো আর হাফপ্যান্ট পরে বের হলাম, তখনো জানতাম না, শত শত বুনো প্রাণীর অভয়ারণ্যে তাদের না জানিয়েই ঢুকে পড়েছি!

পাথারিয়া একটা পরিপূর্ণ জঙ্গল। সুন্দরবনে যেমন কাদা, শ্বাসমূল, লতা, কাঁটা, পচা শামুক আর ঘন গাছের জন্য খুব বেশি ভেতরে যাওয়া যায় না, এখানেও ঠিক এমন—নুড়ি-পাথর, ঝুরা মাটি, কাঁটাগাছ, মাকড়সার ক্যাতকেতে জাল, দুর্ভেদ্য জঙ্গল, সাপের খোলস, শজারুর কাঁটা, ভালুকের মল আর ঠিক এক হাত দূরে ধুপ করে উদয় হওয়া নিরেট পাহাড়ের জন্য এই জঙ্গলও অনেকটা দুর্বোধ্য। এর সঙ্গে ডানে-বাঁয়ে তাকালেই দেখা যায় বড় বড় গাছ মাটির সঙ্গে লেপ্টে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখে মনে হয় এখনো এদের ঘুম ভাঙেনি! ঘটনা আসলে ভিন্ন, এদের ওপর দিয়ে বুনো হাতি চলে গেছে। এসব দেখেই পিলে চমকে যায়! আর তার ওপর যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।

স্থানীয় এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়েছিলাম গাইড হিসেবে। সে ১৫ মিনিট যাওয়ার পরই জঙ্গল কাঁপিয়ে ঘোষণা দিল, ‘বন শেষ, চলেন যাইগা।’

বলে কী ব্যাটা! পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে গুগল ম্যাপ ঘেঁটে দেখি জঙ্গল এখনো শুরুই হয়নি। তাই বাকি পথ ওকে পেছনে রেখে আমরাই গাইড বনে গেলাম।

এই ভ্রমণে আলাদা করে শুধু একটা ঝরনার কথা বলার উপায় নেই। আমরা ১, ২, ৩ করে প্রায় ১২ পর্যন্ত গুনেছিলাম। এরপর গোনা ছেড়ে দিয়েছি। ঝরনাগুলো ছোটখাটো, কিন্তু যাওয়ার রাস্তা সারা জীবন মনে রাখার মতো। একটি ঝরনা দেখতে যাওয়ার পথে প্রায় ১০ মিনিট নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে পার হয়েছি, তা–ও ঘোলা পানি। নিচে–সামনে কী আছে, কোনো ধারণাই ছিল না। বান্দরডুবাতে তো দুই পাহাড়ে পা দিয়েই উঠতে হয়েছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই আকাশ–বাতাস কাঁপিয়ে সহযাত্রী আরমান ভাই পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ে গেলেন! বেশ ব্যথা নিয়েই শেষ করলেন বাকি পথ। সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে গেল বাকিরা, নিজের মনের খেয়ালে এসেছি এখানে, কিন্তু এই জায়গা ছেলেখেলা নয়।

পাথারিয়ার রাতটা মনে রাখার মতো। রাতে আমরা বন বিভাগের বিট অফিসের সীমানায় তাঁবু খাটিয়ে ছিলাম, ভুল করে টর্চলাইট নিভিয়ে ফেললাম একবার, এরপর আর লাইট জ্বালাতে হয়নি। মিটিমিটি করে জ্বলা অগণিত জোনাকি পোকার আলোর কাছে সেদিন হার মেনেছিল ধবধবে পূর্ণিমা!

>রূপসা থেকে পাথারিয়া
‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ আর ‘রূপসা থেকে পাথারিয়া’—এই তো বাংলাদেশ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া তো অনেকেই গিয়েছেন, কিন্তু রূপসা থেকে পাথারিয়া? অনেকের হয়তো পাথারিয়া জায়গাটা কোথায়, সেটাও অজানা। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা থেকে শুরু করে প্রায় ২৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ভারতের আসাম পর্যন্ত সবুজ পাহাড়ের অরণ্য এই পাথারিয়া। হাজার হাজার বছর ধরে রহস্যে আগলে রাখা এই জঙ্গল বুকের মধ্যে চেনা-অচেনা নানা প্রজাতির প্রাণীকে যেমন আগলে রেখেছে, ঠিক তেমনি লোকচক্ষুর আড়াল থেকে লুকিয়ে রেখেছে অনেক বুনো ঝরনাকেও। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় লোকজনের আনাগোনাও কম এখানে। সবাই মাধবকুণ্ড ঝরনা দেখে চলে আসে, কিন্তু কেউ জানেই না যে ঠিক পাশের পাহাড়েই হুমহাম করে বয়ে চলছে পাথারিয়ার সবচেয়ে বড় ঝরনা পুছুম কিংবা তার থেকেও প্রায় দুই ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস বিপৎসংকুল ঝিরিপথ ডিঙালে দেখা মিলবে প্রায় ১২০ ফুট উচ্চতার অনিন্দ্যসুন্দর বান্দরডুবা ঝরনার। আর তার থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে পা বাড়ালেই সামনে পড়বে পাইথুং। বিশালত্ব না থাকলেও এই ঝরনা পাথারিয়া পাহাড়ের একমাত্র ‘ডাবল ফলস’, যার দুদিক দিয়েই পানি পড়ে। যদি কেউ আরও অ্যাডভেঞ্চার চায়, তাহলে সেখান থেকে হাঁটতে হবে আরও দেড় ঘণ্টা, পায়ের নিচে পানি থাকলে ‘কলিজা শুকিয়ে যাওয়া’ এই শ্বাপদসংকুল পথটা পাথারিয়ার সবচেয়ে কঠিন ঝিরিপথ—যদি ডিঙাতে পারেন এ পথ, তবেই দেখা মিলবে ‘রজনীকুণ্ড’ ঝরনার... ফেসবুক পেজ ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার থেকে আমরা গিয়েছিলাম এই পাথারিয়া ‘ম্যাডভেঞ্চার’–এ।

পাথারিয়ার সৌন্দর্য আর মুগ্ধতা এক দিনে শেষ হওয়ার নয়, তাই আমরা পরদিন কাকডাকা ভোরে বেরিয়েছিলাম আবারও। তবে জানিয়ে রাখি, এই বন কিন্তু একেবারেই একলা নয়—হাতি, বানর, হনুমান, বাঘডাশ, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোশ ও বিশাল অজগর সাপের মতো আরও অসংখ্য প্রাণীর আপন আলয় এই জঙ্গল।

বাংলাদেশের উত্তর–পূর্ব সীমানার এই পাথারিয়ায় যেতে নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকুর সীমানা ছাড়িয়েছিলাম আমরা। এই সীমানা ছাড়ানোর মধ্যেই রয়েছে সীমাহীন আনন্দ...

রাকিব কিশোর: ভ্রমণ–লেখক