Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রদীপের নিজের কোনো গন্তব্য নেই : ইরফান খান

>প্রায় দু’বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন ইরফান খান। অনেকে ভেবেছিল, মনোবলের জোরে তিনি ঠিকই লড়াই জিতবেন। কিন্তু না, হেরেই গেলেন। মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে মাকে হারিয়েছিলেন ইরফান। লকডাউনের কারণে মায়ের শেষকৃত্যেও সশরীরে হাজির হতে পারেননি। হয়তো শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল মা হারানোর শোক। গুণী এই ভারতীয় অভিনেতার কথা দুঃসময়ে মানুষের প্রেরণা হতে পারে।
ইরফান খান

আমার ছেলেবেলা কেটেছে জয়পুরে। তখন থেকেই গল্পের প্রতি আমার অসম্ভব ঝোঁক। সবখানে আমি শুধু গল্প খুঁজি। রাতের পর রাত জেগে গল্প শুনতাম রেডিওতে। ওই সময় জয়পুর-আজমির রেডিও স্টেশনে রাত নয়টা/সাড়ে নয়টার দিকে আধঘণ্টার জন্য নাটক শোনাত। সারা দিন অপেক্ষা করতাম সেই নাটক শোনার জন্য। এটা শেষে রেডিওতে আরও গল্প খুঁজতাম। যেদিন ভাগ্যক্রমে রেডিওতে বিবিসি ধরে ফেলতে পারতাম, সেদিন সারা রাত চুম্বকের মতো রেডিওকে কানের কাছে ধরে কাটিয়ে দিতাম।

তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম গল্প বলার। ভেতরের টানটা এত প্রবল ছিল যে তখন মনে হয়েছিল, পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে আমার স্বপ্ন থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমাদের ওখানে সিনেমাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু আমি যে চোখে সিনেমাকে দেখা শুরু করলাম, সেটা আমাকে এমনভাবে আকর্ষণ করল যে আমি নিজেকে থামাতে পারলাম না। আমার কাছে এ যেন ছিল এক রহস্যের জগৎ। অভিনয়েই আমি নিজের ভবিষ্যৎ, নিজের লক্ষ্য দেখতে থাকলাম। আর একজন যখন তাঁর জীবনের লক্ষ্যকে দেখতে শুরু করে, তখন কেউ তাঁকে থামাতে পারে না।

আমার মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন থামাতে। এনএসডিতে (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) পড়তে যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘যেতে চাইলে যাও। বিয়ে করে যা ইচ্ছা তা–ই পড়তে যাও।’ মাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি আমার মনোযোগ ভাগ করতে পারব না। ওই তরুণ বয়সে আমার মনে শেখার তাড়না ছিল। কিন্তু আমি ভালো শিক্ষার্থী হতে পারব কি না, নিশ্চিত ছিলাম না। তবে বড় বড় অভিনেতার অভিনয় দেখে এটা ঠিকই বুঝে গিয়েছিলাম, লক্ষ্যে পৌঁছানোর আমার এই সফর অনেক লম্বা হবে, অনিশ্চিত হবে। তবে অনিশ্চয়তায় বেঁচে থাকার সৌন্দর্য অন্য রকম। কারণ, আমাদের সবই ক্ষণস্থায়ী। আমরা চাইলেই জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সামনে অনেক পথ। আমরা শুধু নিজের পথটা বেছে নিতে পারি।

লক্ষ্যের দিকে চলতে চলতে মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগত। অভিনয় ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হতো। অনেক ভুল ছবিতে কাজ করেছি, অনেক সময় আফসোস হয়েছে। কিন্তু আমি কী চাই, সেটা জানার জন্য এসব করার প্রয়োজন ছিল। পরে উপলব্ধি করেছি, প্রতিটা কাজেই আসলে এমন পর্যায় থাকে, যখন হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয়। সেই পর্যায়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, ‘আমি কি এই কাজ শুধু নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য করছি? নাকি এই কাজের সঙ্গে আমি নিজেকে মন থেকে জুড়ে ফেলেছি?’ ক্লান্তি বোধ করলে প্রত্যেক পেশার, প্রত্যেক মানুষেরই নিজেকে এই প্রশ্নটা করা উচিত। ক্লান্ত লাগলে আমিও নিজেকে এই প্রশ্ন করি। তখন আমার একটা লাইন মনে পড়ে। সেবার কোথাও যাচ্ছিলাম। আমার হাতে একটা হিন্দি বই ছিল। তখন এক সহযাত্রী আমার কাছে থেকে বইটা চেয়ে নেন। যাওয়ার সময় ওই বইয়ের প্রথম পাতায় তিনি একটা লাইন লিখে যান। সেটা অনেকটা এ রকম, ‘যেখানেই যাবে তুমি আলো ছড়াবে, কারণ, প্রদীপের নিজের কোনো গন্তব্য নেই।’ তাই আমি আর আমাকে খুব চাপ দিই না। জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমি আজ এখানে আছি, কাল অন্য কোথাও থাকব। পাঁচ বছর পর হয়তো আমি আর থাকবই না।

মোট কথা, অনিশ্চয়তাকে মেনে নেওয়ার পর থেকে, অনিশ্চয়তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করার পর থেকে আমি তাড়াহুড়ো করি না। যা ভালোবাসি করে যাই। জীবনে যা আসবে, দেখা যাবে।

আদর রহমান

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও মোটিভেশন টু মুভ অবলম্বনে