Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রাণ খুলে হাসো, যত ইচ্ছে বই পড়ো

দুই বন্ধু—বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট। ছবি: সংগৃহীত
>বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট—একজন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, অন্যজন বিখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষের তালিকায় শীর্ষ স্থানটি নিয়ে দুজনের প্রতিযোগিতা হতে পারে, কিন্তু আদতে দুজনই খুব ভালো বন্ধু। ২০১৬ সালে ওয়ারেন বাফেটের সঙ্গে বন্ধুত্বের ২৫ বছর উপলক্ষে নিজের ব্লগে (গেটসনোটস ডটকম) একটি লেখা লিখেছিলেন বিল গেটস। আজ বন্ধু দিবস উপলক্ষে সেটিই ছাপা হলো স্বপ্ন নিয়ের পাঠকের জন্য।

কবে কোন বন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, সেসব কথা মনে রাখা কঠিন। বেশির ভাগ বন্ধুর ক্ষেত্রেই আমি তা ভুলে গেছি, শুধু ওয়ারেন বাফেট ছাড়া। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখার দিনক্ষণ আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে—৫ জুলাই, ১৯৯১। 

ওয়ারেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমাকে দুটো জিনিস শিখিয়েছে। তাহলো প্রাণ খুলে হাসো আর যত ইচ্ছে বই পড়ো। এই দুটো কাজ একজন ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় যতই করুক না কেন, কখনো বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না। 

আজ এক শতাব্দীর এক–চতুর্থাংশ পূরণ হয়েছে। অর্থাৎ, আমাদের বন্ধুত্বের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা প্রচুর হেসেছি, প্রচুর পড়েছি। আমার স্ত্রী মেলিন্ডা আর আমি ওয়ারেনের দেওয়া এসব রত্নসম জ্ঞানসম্ভারের কথা প্রায়ই মনে করি। প্রায়ই হেসে উঠি ওয়ারেনের বলা কোনো কৌতুক মনে করে। অজান্তে হেসে ফেলি ওয়ারেনের কোনো অদ্ভুত কাণ্ডের কথা মনে করে! 

বন্ধুত্বের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাই ঠিক করেছি, পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করব। আজকের আলোচিত ঘটনাগুলো ওয়ারেনের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলোর কিছু অংশ। 

শুরুটা ছিল দৈবাৎ

প্রথম দেখায় আমার ও ওয়ারেনের মধ্যে তেমন মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমি প্রযুক্তি-পাগল; বলা চলে আঁতেল। আর ওয়ারেন নামকরা বিনিয়োগকারী। যিনি কিনা ই–মেইল ব্যবহার করেন না! 

সত্যি কথা বলতে, আমি কখনো আশাও করিনি একদিন আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হব। 

১৯৯১ সাল। মা হুট করে ফোন করলেন। বললেন, হুড কানালে চলে যেতে। ওখানে আমাদের বাড়ি আছে। অবকাশ যাপনের জন্য বানানো হয়েছিল। 

মা অনেককে নিমন্ত্রণ করেছেন। তাঁদের একজন ওয়ারেন বাফেট। 

আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, যেতে পারব না। প্রচুর ব্যস্ততা। 

মা-ও নাছোড়বান্দা, ওয়ারেন চমৎকার লোক। আমার তাঁকে ভালো লাগবে। 

কিন্তু আমাকে আশ্বস্ত করা কঠিন। বললাম, ‘শোনো মা, তাঁর কাজ হলো দলিলপত্র কেনাবেচা করা। আমার মনে হয় না আমরা কথা বলার কোনো বিষয় খুঁজে পাব!’ 

শেষমেশ মায়েরই জয় হলো। আমাকে রাজি করিয়ে ফেললেন। আমিও শর্ত জুড়ে দিলাম—দুই ঘণ্টার বেশি থাকতে পারব না। এরপর কাজে ফিরে আসব। 

ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমাকে সফটওয়্যার নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। বললেন, আইবিএমকে টেক্কা দিয়ে বাজারে টিকে থাকা কঠিন। মাইক্রোসফটের মতো একটা খুদে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রস্তুতি বা দক্ষতা কেমন? আমাদের মূল্যনির্ধারণ নীতি কেমন? 

চমৎকার প্রশ্ন। এর আগে কেউ আমাকে এমন প্রশ্ন করেননি। 

আড্ডা জমে উঠল। বুঁদ হয়ে গেলাম। কেটে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। 

প্রকৃতপক্ষে, ওয়ারেন বাফেটকে দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি বড় মাপের বিনিয়োগকারী! বিনয়ের সঙ্গে কথা বলেন। নিজের কাজের কথা বললেও হামবড়া শোনায় না। নিরহংকারী, রসিক লোক। 

তবে তাঁর একটি গুণ আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করল। তিনি জগৎ নিয়ে ভাবেন। আর সেই ভাবনা বা জ্ঞান পরিষ্কার ও পরিশীলিত। 

সেদিনের সেই আলোচনার পর থেকে আমাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। 

বিস্কুট দিয়ে প্রাতরাশ

ওয়ারেনের একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে। আমরা ছেলেবেলায় যেসব খেতাম, তিনি এখনো সেসব খান! অর্থাৎ তাঁর খাদ্যাভ্যাস মোটেও বদলায়নি। তবে তাই বলে বার্লি কিংবা সাগুদানা কিন্তু নয়। তিনি পছন্দ করেন হ্যামবার্গার, আইসক্রিম, কোক—এ–জাতীয় খাবার! (এ কারণে তাঁর সঙ্গে খেতে বেরিয়েও আনন্দ!) 

প্রথম যেদিন তিনি আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন, সকালবেলা নাশতার সময় অরিও বিস্কুট নিয়ে বসলেন। কারণ, এই দিয়েই তিনি প্রাতরাশ সারবেন! আর বাচ্চারাও বলে বসল, তাদেরও চাই! এমন খাদ্যাভ্যাস ছোটদের জন্য অনুসরণীয় নয়। কিন্তু তাঁর কথা আলাদা। এমন খাদ্যাভ্যাসে নিজেকে দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন! 

 ‘আপনার সেই ডাইনিং রুমের ঘটনা আমি আজও ভুলিনি ওয়ারেন!’ 

একদিন আমি ও মেলিন্ডা তাঁর বাড়িতে থাকতে গিয়েছি। সেদিন তিনি আমাদের সারা বাড়ি ঘুরে দেখালেন। যখন খাবার ঘরে এলাম, দেখি খাবার টেবিলে চেয়ার আছে, কিন্তু তাতে কুশন নেই! 

আমরা অবাক! এমনকি ওয়ারেনও। আশপাশে খুঁজে দেখে বিড়বিড় করে বললেন, ‘অদ্ভুত কাণ্ড!’ 

পরে অবশ্য জানা গেল, মাস কয়েক আগে ওয়ারেন নিজেই নতুন কুশন কিনবেন বলে পুরোনোগুলোকে দোকানে পাঠিয়েছিলেন। এরপর আর আনা হয়নি। মনেও নেই! (তিনি বোধ হয় রান্নাঘরে বসেই তাঁর অরিও আর আইসক্রিমগুলো সাবাড় করতেন!) 

এ ঘটনা মনে এলে আমরা এখনো খুব হাসি! 

বিশ্বমানের উপদেশ পেতে দুই ডায়াল করুন 

অফিসে যখন থাকি, স্পিড ডায়ালের জন্য আমার দুটি নির্দিষ্ট নম্বর থাকে। একটি বাড়ির, আরেকটি ওয়ারেনের। যদি ওয়ারেন ফোন ধরতে পারেন, তো সেটি হলো আমার জন্য সেই সপ্তাহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা! 

আমি প্রতিনিয়ত তাঁর থেকে কিছু না কিছু শিখি। আমাদের আলোচনার বিষয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, নতুন আবিষ্কার বা প্রবর্তন কিংবা বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে ভাবনা। তিনি সবকিছু দেখেন অর্থনৈতিক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, আর আমি দেখি প্রযুক্তিবিদ চোখ দিয়ে। 

ওয়ারেন আমাদের বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের একজন উল্লেখযোগ্য ট্রাস্টি। তিনি আমার ও মেলিন্ডার জন্য একজন বিশেষ চিন্তাসঙ্গী বা ‘থট পার্টনার’, যিনি আমাদের চিন্তা বা সিদ্ধান্তকে আরও পরিশীলিত করতে সাহায্য করেন। 

আমরা যখনই কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই, নিজেদের প্রশ্ন করি; এখানে ওয়ারেন থাকলে কী করতেন? এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের সদুত্তর পেতে সাহায্য করে। 

কর্ম ও অর্জনের বিবেচনায় আমরা একই পর্যায়ে পড়লেও ওয়ারেন আমার চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান। এদিক থেকে তিনি আমার কাছে পিতৃতুল্য। 

বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা

লোকমুখে ওয়ারেন বাফেট ‘ওমাহার ওরাকল বা বিজ্ঞজন’ নামে পরিচিত। ব্যবসায়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ। একইভাবে বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে পটু। এটি যেন তাঁর সহজাত গুণ। 

আমি অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি তিনি কী সহজে সবাইকে আপন করে নেন! তখন তাঁর থেকে কিছু শেখাটাও আনন্দের হয়ে দাঁড়ায়। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বন্ধুদের জন্য সময় করে নেন। খুব কম লোককেই দেখেছি, যাঁরা বন্ধুত্বকে এভাবে লালন করেন। 

একটা ‘হ্যালো’ বলার জন্য হলেও তিনি সব সময় ফোনে যোগাযোগ রাখেন। যদি কোনো নিবন্ধ পড়ে মনে হয়, আমি ও মেলিন্ডা নিবন্ধটা পছন্দ করতে পারি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। 

গত ২৫ বছরে ওয়ারেনের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি শিখেছি তা হলো—বন্ধুত্ব কেমন হওয়া উচিত! অর্থাৎ, তোমাকে এমন এক বন্ধু হতে হবে, যেমনটা তুমি তোমার বন্ধুর কাছে আশা করো। ওয়ারেনের মতো চিন্তাশীল ও সহানুভূতিপ্রবণ বন্ধু পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হোক! 

ওয়ারেন নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে অন্যকে তাঁর সম্পর্কে ভালো বোধ করাতে পছন্দ করেন। তিনি চেষ্টা করেন, যেন অন্যরাও নিজের জীবনকে তাঁর মতোই উপভোগ করে যেতে পারেন। 

এখনো যখন সময় পেলেই ওমাহা বেড়াতে যাই, ওয়ারেন গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে চলে আসেন আমাকে স্বাগত জানাতে। কারও কাছে এটা নিতান্ত সৌজন্য মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা অনেক বড়। প্লেনের দরজা খোলার আগে আমার ভেতর এখনো শিশু বয়সের উত্তেজনা কাজ করে। ওপাশে যে ওয়ারেন অপেক্ষা করছেন তাঁর হাসি ও গল্পের ঝুলি নিয়ে! 

ওয়ারেন, আপনার বন্ধুত্বের জন্য ধন্যবাদ। আমাদের বন্ধুত্বের অসাধারণ কিছু বছর কেটে গেছে। আগামী দিনগুলোতেও আপনার সঙ্গে আমি আরও মজার সব স্মৃতি গড়তে চাই। 

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: 

শাহরোজা নাহরিন

সূত্র: গেটসনোটস