Thank you for trying Sticky AMP!!

ফুটবলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ

মাহবুবুর রহমান। ছবি: সুমন ইউসুফ

মাহবুবুর রহমানকে (যদিও সে সুফিল নামেই পরিচিত) নিয়ে লেখার শুরুতেই বলে নিই, ‘ভালো খেলে’ আর ‘ভালো খেলোয়াড়’-এর মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফুটবল বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় সারিতে হলেও ভালো খেলে এ রকম ফুটবলার অনেকে দেখেছি। কিন্তু ভালো ফুটবলার বলতে যা বোঝায়, তা আমি মাহবুবুরের মধ্যে দেখতে পাই। অর্থাৎ মাঠে ভালো খেলা এই তরুণের মাঠের বাইরের জীবন অনেক বেশি প্রশংসনীয়।

মাঠের বাইরের সুবোধ জীবনের গল্পে পরে যাব। শুরুতে মাঠের মাহবুবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। ২০১৬-১৭ মৌসুমে শেখ রাসেলের কোচ থাকার সময় আরামবাগের জার্সিতে আনকোরা ছেলেটিকে প্রথম দেখি। শুরুতে আহামরি কিছু মনে হয়নি। আট-দশটা তরুণ ফুটবলারের মতোই। তবে ওর গতি একটু আলাদাভাবে নজর কেড়েছিল।

আমি পেশাদার কোচ। কখন কোন দলের হয়ে ডাগআউটে দাঁড়াতে হয়, এর কোনো আগাম ধারণা থাকে না। পরের মৌসুমেই যেমন আমি হয়ে গেলাম আরামবাগের কোচ। দলে পুরোনো খেলোয়াড় হিসেবে পেলাম মাত্র মাহবুবুর ও রবিউলকে। ওরা যেহেতু ক্লাবের সিনিয়র ফুটবলার, ওদের দিয়েই প্রথম দিনের অনুশীলনে ওয়ার্মআপ সেশন করালাম। ছেলেটা নজর কেড়ে নিল ওর ব্যক্তিত্ব দিয়ে। কিছুদিন পর ফিটনেসের কঠিন ইয়ো ইয়ো টেস্ট (শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের একটি পরীক্ষা) নেওয়া হলো। সেখানে শুধু মাহবুবুরই সব কটি ধাপ শেষ করতে পেরেছিল। ওর স্কোরটা আমি এখানে লিখছি না। শুধু এতটুকু বলছি, বিশ্বমানের। তখনই বুঝলাম আর যা-ই হোক, মাহবুবুর রহমান নামের এই তরুণ তুর্কির ফিটনেস বিশ্বমানের ফুটবলারদের মতো।

ভালো ফিটনেসের সঙ্গে বলের ওপর দক্ষতাও ভালো। আমার একাদশে ও নিশ্চিত। আর যেহেতু ক্লাবের সিনিয়রদের মধ্য থেকে একজনকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিতে হবে, আমি মাহবুবুরকেই বেছে নিলাম। একে তো তার একাদশে খেলা নিশ্চিত, দ্বিতীয়ত তার নেতৃত্বগুণ। দলের ছোট-বড় সব খেলোয়াড়ের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ভালো। দলের পক্ষ থেকে একজন অধিনায়ক হিসেবে কোচের সঙ্গে যে রকম যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত, তা ওর মধ্যে আছে। ব্যস, উনিশ বছরে পা রাখা একটা ছেলের কাঁধে তুলে দিলাম প্রিমিয়ার লিগের একটা ক্লাবের অধিনায়কের নেতৃত্ব। আমার সেই তারুণ্যনির্ভর দলটা তো শেষ পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৮ সালে স্বাধীনতা কাপেও চ্যাম্পিয়ন হলো।

আমি সাধারণত খেলোয়াড়দের যোগ্যতার ওপরই মাঠের ফরমেশন সাজিয়ে থাকি। মাহবুবুরের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রেখে প্রথমবারের মতো ৩-৪-৩ ফরমেশনে দল সাজিয়েছিলাম। মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলে অধিনায়ক মাহবুবুর হয়ে উঠল বক্স টু বক্স উইঙ্গার। প্রতিটা আক্রমণেই থাকত তার উপস্থিতি, আবার বল হারিয়ে গেলে রক্ষণ সামলানোর সময়ও একেবারে নিচে নেমে আসা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন কোচ উইঙ্গারের কাছ থেকে যা আশা করে, সবকিছুই আমি ছেলেটির মধ্যে পেয়েছি।

আরামবাগ ক্লাবের সহযোগিতায় সে বছরই আমার হাত ধরে বাংলাদেশে প্রথম গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার শুরু হয়। সে সুবাদে জানি মাহবুবুর প্রতি ম্যাচে গড়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দৌড়েছে। বাংলাদেশের একজন ফুটবলার হিসেবে এই পরিসংখ্যানটা তো অবশ্যই ঈর্ষণীয়, সঙ্গে বিশ্বমানেরও।

জাতীয় দলের জার্সিতে মাহবুবুরের অভিষেকটা আমার চোখের সামনে এখনো ভাসে। ভিয়েনতিয়েনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক লাওসের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হওয়া। বদলি নেমে শেষ সময়ে নতুন জার্সির ঘ্রাণ গায়ে লেগে থাকতে থাকতে গোল করে লাওসের বিপক্ষে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনেছিল ২-২ সমতায়। আন্তর্জাতিক অভিষেক ম্যাচেই বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারের গোল দেখে অনেকে অবাক হলেও আমি হইনি। আমি জানতাম সুফিল কী করার ক্ষমতা রাখে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, গোল করার চেয়ে মাহবুবুর রহমান সুফিল বেশি পারদর্শী গোল করানোয়। দুরন্ত গতির সঙ্গে বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ভালো। কম্বোডিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের শেষ আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচের জয়সূচক গোলের কারিগর হিসেবে ওর ক্যারিয়ার একধাপ এগিয়ে গেছে। রবিউলের গোলটি যতটা না মাধুর্য ছড়িয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি প্রশংসিত হয়েছে সুফিলের সেই ভোঁ দৌড়। প্রতি-আক্রমণে ঝড়ের গতিতে ওই একটা মুভই খুলে দিয়েছিল গোলমুখ। মাহবুবুরের সেই দৌড় দেখে অনেকেরই প্রশ্ন, বাংলাদেশের কোন ফুটবলার এত জোরে দৌড়াতে পারে! আমি জিপিএস রেকর্ড বের করে দেখলাম, সুফিল প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ৮.৯ মিটার (হিসাবটা গত বছরের) বা ঘণ্টায় ৩২.০৪ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে। ওর এই শক্তিটা সহজাত। সঙ্গে যোগ হয়েছে নিয়মতান্ত্রিক কঠোর পরিশ্রম।

এই সবই একজন ভালো খেলোয়াড়ের গুণ। তবে সুফিলকে বেশি আলাদা করে দিয়েছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একজন আদর্শ ফুটবলারের যা গুণ থাকা দরকার, ছেলেটার তা আছে। বর্তমান সময়ে ওর মতো নম্র, ভদ্র, দায়িত্বপরায়ণ ও নিবেদিত ফুটবলার খুব কম দেখা যায়। ছেলেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সেরা ফুটবলার হওয়ার সামর্থ্য রাখে মাহবুবুর। ও দেশের ফুটবলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

অনুলিখিত

মারুফুল হক: বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ।