Thank you for trying Sticky AMP!!

বন্ধুত্বে গড়া পাঠাও

সিফাত আদনান (বাঁয়ে) ও হুসেইন মো. ইলিয়াস। ছবি: ছুটির দিনে

লিফটের ৯, মানে ১০ তলা। ঢাকার বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ। কাচঘেরা ঝাঁ–চকচকে ভবন। লিফট থেকে নেমে কাচের দরজা ঠেলে অভ্যর্থনা। পাশেই একটা লাল মোটরসাইকেল রাখা। দেশি প্রতিষ্ঠান রানারের তৈরি।

‘এটা আমাদের প্রথম বাইক।’

আমাদের মানে সিফাত আদনান আর হুসেইন মো. ইলিয়াসের। দুই বন্ধুর প্রথম বাইক, ১০ তলার ওপরে সাজিয়ে রাখা। হতেই পারে, কী আর এমন। কিন্তু তো একটা আছেই, পাঠকও হয়তো বুঝে গেছেন নাম দুটো পড়ে। এই বাইক এখন ইতিহাসের অংশ। সিফাত আদনান বলেই দিলেন, ‘পাঠাওয়ের প্রথম বাইক এটা। আমরা এটাকে ভুলতে পারি না।’

এই দুই বন্ধু—মুঠোফোনের অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক পরিবহনসেবা পাঠাওয়ের দুই প্রতিষ্ঠাতা ভোলেন না অনেকই কিছুই। হুসেইন মো. ইলিয়াস পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আর সিফাত আদনান প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও)। যেদিন কথা হচ্ছিল সেদিন চৈত্রসংক্রান্তির দিন। প্রতিবেদনের জন্য ছবি তোলার বিষয় ছিল। দুজনেই পাঞ্জাবি পরে এলেন। সিফাতের পরিপাটি পাঞ্জাবিতে বাংলা নববর্ষের ছোঁয়া। ছবি তোলার জন্যই নাকি এই পোশাক পরেছেন।

কথার শুরুটাই হলো বন্ধুত্ব দিয়ে। ‘১০ বছর ধরে আমাদের বন্ধুত্ব।’ বললেন সিফাত। তাঁর এক কাজিন ইলিয়াসের বন্ধু। তখন দুজন দুই নগরে। ইলিয়াস ঢাকায়, সিফাত রাজশাহী। কথা চলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে। দুজনের সামনাসামনি দেখা ২০১১ সালে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক হয়ে সিফাত ঢাকায় এসেছেন চাকরি করতে। ওদিকে ইলিয়াস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তখন ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। দুজনেরই ইচ্ছা চাকরি নয়, নতুন কিছু করার। ইলিয়াসের বাসা কমলাপুরে, সিফাতের উত্তরায়। দেখাটা কমই হয়। কিন্তু কথা চলে—তরুণদের ‘নিড’ মানে চাহিদা নিয়ে ভাবেন।

ভাবতে ভাবতে ২০১৩ সালে সিফাত ও ইলিয়াস ডুগডুগি বাজানো শুরু করলেন। এটা অনলাইন গান শোনার ওয়েবসাইট (মিউজিক স্ট্রিমিং সাইট)। সে বছরই স্টার্টআপ উইকএন্ড, ঢাকার আয়োজনে দ্বিতীয় পুরস্কার পেল ডুগডুগি। ওয়েবসাইটটি সংগীতপ্রেমীদের কাছে সাড়াও জাগাল, কিন্তু বাণিজ্য লক্ষ্মী দেখা দিলেন না। ইলিয়াস বলেন, ‘তখন ঢাকায় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের গতি ধীর। অনেকেই আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ইন্টারনেটের কম গতির কারণে সুবিধা করা গেল না।

ডুগডুগি বেশি দিন বাজানো গেল না। আবারও ভাবনা শুরু সিফাত ও ইলিয়াসের। নিজেদের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছেন ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় জিনিসপত্র পাঠানো তো আরও জটিল। ‘বাইসাইকেল দিয়ে পার্সেল পাঠানোর ধারণা এল মাথায়। যাতে পার্সেল দ্রুত পাঠানো যায়।’

শুরু হলো এই উদ্যোগ। কয়েকজন ডেলিভারি ম্যান, ফোনের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো, প্রয়োজনে নিজেরাও পার্সেল পাঠানোর কাজ করতেন। এই উদ্যোগের নামও রাখা হলো পাঠাও। ইলিয়াস বলেন, ‘একটা সময় দেখলাম মানুষের তো প্রতিদিন পার্সেল পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না।’

আবার চিন্তা শুরু। ঢাকা যানজটের শহর, বাস, গাড়ি, সিএনজি—সবই যানজটে আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু গাড়ির পাশ দিয়েই মোটরবাইক চলে যায় দ্রুত। ‘২০১৬ সালে পাঁচটা মোটরবাইক নিয়ে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে থাকতাম। বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। প্রথম প্রথম সহজে কেউ আস্থা পেতেন না। একজন বাইকে করে বাড়ি গেলেন, এরপর আরেক দিন আরেকজন। এক–দুই–তিন দিন—চতুর্থ দিন ফোন এল বাইক সেবার জন্য। এভাবে আস্থায় এল সেবাটা।’ তখনো প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি পাঠাওতে। কল সেন্টারে ফোন করে করে বাইক খোঁজা হতো।

একসময় দেখা গেল এভাবে হাতেকলমে এই উদ্যোগ চালানো সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে চালু হলো পাঠাও অ্যাপ। ইলিয়াস বলে চলেন, তখন ফেসবুক পেজের যুগ। বাইক আরোহীরা ফেসবুকে স্বচ্ছন্দ। ফেসবুক পেজের পাশাপাশি অ্যাপ চালু হলো। অ্যাপের প্রোগ্রামিং পুরোটাই করলেন নিজেরা।

এরপর ইতিহাস। দ্রুত জনপ্রিয় হলো পাঠাও অ্যাপ। দেশে থ্রি–জি এল ফোর–জি এল। এখন আর কল সেন্টার নেই, অ্যাপেই কাজ করে পাঠাও। দেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও গাজীপুর এবং বিদেশে নেপালের কাঠমান্ডুতে চলে পাঠাওয়ের সেবা। মানুষের যাতায়াতের সুবিধা শুধু নয়, কর্মসংস্থানের সুযোগও হলো। দেশে মোটরবাইক উৎপাদনও বেড়ে গেল। ২০১৭ সালে যোগ হলে পাঠাও কার (গাড়ির সেবা), ২০১৮ সালে এল পাঠাও ফুড (রেস্তোরাঁ থেকে খাবার আনানোর সেবা)। পাঠাওয়ে দুই লাখ বাইকচালক নিবন্ধিত। গড়ে এক লাখ সক্রিয় থাকেন। প্রতিদিন এক লাখ রাইড হয় পাঠাওয়ে।

পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গত মাসেই বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস–এর ৩০ অনূর্ধ্ব ৩০ তরুণের তালিকায় স্থান পেয়েছেন ২৯ বছর বয়সী হুসেইন মো. ইলিয়াস। সিফাতের বয়স ৩১ বছর বলে এ তালিকায় তিনি আসেননি। পাঠাওয়ের এখন কর্মিসংখ্যা ৬০০। বড় একটা দল আছে কারিগরি ব্যাপার দেখার জন্য। যে দলের নেতৃত্বে আছেন সিফাত। ব্যবসায়ের অংশটা দেখেন ইলিয়াস।

ইলিয়াস ও সিফাত একটা ব্যাপারে গর্ব করতেই পারেন। পাঠাও অ্যাপের প্রোগ্রামিংয়ের পুরোটাই দেশি প্রকৌশলীদের করা এবং তা বাংলাদেশে বসেই। যখন পাঠাও রাইড দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকল, তখন সার্ভার সমস্যা করত। এমনও হয়েছে যখন পিকটাইম তখন বাইকচালক বা আরোহী কেউ কারও সঙ্গে যুক্ত হতে পারতেন না। ‘রাতদিন খেটে সেগুলো আমরা ঠিক করেছি। এখন অ্যাপ যথেষ্টই স্থিতিশীল।’ বন্ধুত্বে গড়ে ওঠা পাঠাও যেন এখন মানুষের বন্ধু হয়ে উঠেছে।

পাঠাও কুরিয়ারও এখন চালু হয়েছে। আর পাঠাও অ্যাপে আছে সেই পার্সেলও। প্রথম সেবার কথা ভোলেননি এর দুই প্রতিষ্ঠাতা। আধুনিক ভবনের চারটি তলা নিয়ে নতুন কার্যালয় থাকার পরও যেমন ভোলেননি বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকার একটি ছোট্ট গ্যারেজে থাকা প্রথম অফিসটির কথাও। ইলিয়াসের কথায়, ‘ওটা আসলেই এক গ্যারেজ। এখনো আমরা ওই অফিস রেখেছি।’

পল্লব মোহাইমেন: প্রথম আলোর উপফিচার সম্পাদক