Thank you for trying Sticky AMP!!

বলতে পারার সাহস চাই

পারিবারিক সম্পর্ক এমনই আনন্দময় হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে আনন্দের বদলে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। মডেল: সাদিয়া, তারেক, দীনা ও আদিব। ছবি: সুমন ইউসুফ

খুব ছোটবেলা থেকে কিশোর কিংবা তরুণ বয়সের একটা সময় পর্যন্ত অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। সেসবের প্রতিবাদ করা, সেসব নিয়ে কথা বলা ওই সময়ে প্রায় অসম্ভব আর বিরাট দ্বিধা-সংশয়ের বিষয় ছিল। ভাবতাম, লোকে কী বলবে। আমাকে নিশ্চয় খুব খারাপ ভাববে। এখন সেই ভয় অনেকটা কেটেছে বলা যায়। বরং মাঝে মাঝে কষ্ট হয় এই ভেবে, কেন ওই সময়গুলোতে সেসব দ্বিধা কাটাতে পারিনি। আজকে এ রকম না বলা নিজের কিছু কথা দিয়ে ঘরের ভেতরে পারিবারিক সহিংসতার নিয়ে পাঠকের সঙ্গে আলাপ শুরু করতে চাই।

খুব ছোটবেলায় যখন নারী-পুরুষের ফারাক, নিজের শরীর-যৌনতা-হয়রানির ইত্যাদির সংজ্ঞা ভালো করে বুঝি না, তখনই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনার মুখোমুখি হই। সেই ৪/৫ বছর বয়সেই যখন নিপীড়নকে নিপীড়ন বলে বোঝার বয়সও হয়নি, তখনই খুব কাছের আপনজনদের হাতে নানা রকম যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আমার। যখন এই নিপীড়ন ও সহিংসতাকে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করেছি, তখন দিনেরাতে ভয়ে থাকতে হতো, কখন আবার শরীরের আশপাশ ঘেঁষে স্পর্শের চেষ্টা করবে সেই আত্মীয়রা। ঘরের বাইরে বাসে রাস্তায় নানা হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা আজ আর না বলি, নিপীড়নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায়ও না যাই। শুধু এটুকু বলি, শরীরে পুরুষের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শর ভয় তাড়া করে বেড়াত তখন। খুব সাবধানে চলতে হবে, এ কথাটা মাথায় নিয়ে বেড়াতাম। কাউকে বললে হয়তো ভাববে, আসলে ভুল বুঝছি। ছোট বাচ্চাকে আদর করার ব্যপারটাকে নিপীড়ন বলে ভাবছি। বা আসলে আমি ‘খারাপ’।

আজকে যেটুকু বললাম, তা বলতে পারা হয়তো সাহসের, কিন্তু বড়াইয়ের নয়। কারণ, এই অভিজ্ঞতা কেবল আমার নয়, আমাদের সবার। আমার মতো এমন অভিজ্ঞতা আমার খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে আমি বহুবার শুনেছি। শুনেছি, কী করে ঘরে নিজ স্বামীর হাতে বলাৎকারের শিকার হয়েছে স্ত্রী। শুনেছি কী করে বনিবনা না হলে চোখে-মুখে আঘাত করে পালিয়েছে স্বামী বা প্রেমিক। শুনেছি, কীভাবে কথা না শুনলে জমিদারি কায়দায় নিজের বাবা বা মা অত্যাচার করেছে তার সন্তানদের। আর সেসব অনুভূতি তাদের মনন গঠনে কত বাধা দিয়েছে, তার গল্প।

ছোটবেলা-মাঝবেলা কিংবা বড়বেলা—আমাদের পুরো সময়টা ধরে নারী হিসেবে যে অভিজ্ঞতা, সেখানে গা ঘিনঘিন বা ছমছম করার, ভীষণ অস্বস্তি ও অপমানের, রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া হয়রানির ঘটনা আছে সবার। এসব তাড়া করে বেড়ানো অভিজ্ঞতার আমরা নানা নাম দিই—নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, যৌতুক, অ্যাসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিবাহ, নানা রকম পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা নামে। যদি কোনো নারী বুকে হাত দিয়েও বলেন, তিনি তাঁর তাবৎ জীবনে এর কোনো একটিরও জন্যও কখনো মুখোমুখি হননি, সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল। ইদানীং পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে পত্রপত্রিকায় নানা সংবাদ ফলাও হয়ে ছাপা হচ্ছে। সত্যি কথা হলো, বিচিত্র সব হয়রানির মধ্যে পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে নারী নিজেও সবচেয়ে নাজুক থাকে। কিন্তু কেন আমরা ঘরসংসারের খবর নিয়ে এত নাজুক থাকি, আতঙ্কে থাকি? কুল রক্ষার নামে এসব আড়াল করে করে নিজের-নারীর আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে কি আমরা বলী দিচ্ছি না, প্রশস্ত করছি না হয়রানির পথ? এসব নাজুকতা, আতঙ্ক প্রতিদিন বলি হওয়ার আয়োজন, আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে না পারার দিকগুলোকে এখন প্রশ্ন করার সময়। নারীকেই সেই প্রশ্ন আগে করতে হবে।

আমরা সব সময় নিজ ঘর থেকে বাইরের খবর পেতে ভালোবাসি, নিজেকে আয়নায় দেখার বদলে হরেক রকম বাজারি গল্পের খোঁজে অন্যের জানালায় উঁকি দিয়ে গন্ধ শুঁকি। অন্যের দিকে নিশানা তাক করি নিজের দায় পরের কাঁধে চাপানোর সাধে। নিজের ঘরের কথা বাইরে গেলে ঘরের দেয়ালের চুন-সুরকিতে ফাটল ধরবে, পরম্পরার সুনাম যাবে, সম্মান খোয়াতে হবে কিংবা ভাঙনও ঘটে যেতে পারে—এসব নানা আতঙ্ক কাজ করে আমাদের। আর তাই নারীর ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে প্রায়শই নিজের অভিজ্ঞতাগুলো—বিশেষভাবে একেবারে ঘরের ভেতর আপনজন-আত্মীয়র কাছ থেকে নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলো—এড়িয়ে যাই আমরা।

যতই এড়িয়ে যেতে চাই, আড়াল করতে চাই, চাপা রাখতে চাই—গোপন রাখার সুযোগ আজকের জামানায় আর নেই। আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষক নারী এখন আর ঘরের চার দেয়ালে বন্দী নয়। মধ্যবিত্ত নারীদেরও অন্দরমহলে পিতা-বড় ভাই-স্বামী আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বয়ে বেড়ানো নারী-পুরুষ-ময়মুরব্বি ও পাড়া-প্রতিবেশীদের তোয়াক্কা করে চলার সুযোগ নেই। নারীদের মধ্যে মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিতরা এখন শ্রমিক নারীর মতো ঘরের অর্থনৈতিক দুর্দশার সামাল দিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। মধ্যবিত্তের মধ্যেও নতুন অভিজ্ঞতা নতুন দুর্ভোগ নিয়ে হাজির আছেন নতুন নারী, যাঁরা দায়িত্ব নিচ্ছেন নিজের, ঘর-সংসারের, পরিবারের। আর এই দায়িত্ব নিতে গিয়ে যখন অন্দরমহলের দরজার বাইরে পা রাখছেন, তখন তাঁদের অনেকের ঘরের কথাই বাইরে চলে আসছে। ঘরের কথা যত বেশি বাইরে আসবে, তত এই নিপীড়ন কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। তবে এটাও িঠক, পরিবারের বন্ধন যত বেশি জোরদার হবে, পারিবারিক সহিংসতা ততই কমে আসবে।

ঘরে নির্যাতিত-নিপীড়িত-ধর্ষিত হওয়ার ফলে কর্মস্থলে নানা সংকটসহ আর্থিক-সামাজিক জীবনেও নারী নানা সংকট-সমস্যায় পড়ছেন। ছিটকে পড়ছেন পেশাজীবনের সাফল্য থেকে। ভুগছেন হীনম্মন্যতায়। কর্মজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবীসহ সব নারীর কথা ভেবে সরকারকে বাধ্য হতে হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, ২০১০ আইন প্রণয়নের বিল পাস করতে।

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০; যার ধারা ৩ অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা বলতে ‘পারিবারিক সম্পর্ক রহিয়াছে এমন কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোনো নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতি বুঝাইবে।’ কিন্তু এই আইনের সব বদলে যায়নি। নিপীড়ন বন্ধ হয়নি।

পারিবারিক সহিংসতার কথা ভাবতেই সাম্প্রতিক সময়ে আমার প্রতিবেশী ভ্যানচালক হজরত আলীর কথা মনে পড়ে গেল। হজরত আলী প্রায় পাঁচ মাস ধরে তাঁর মেয়ে আঁখির হত্যার বিচারের দাবিতে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে তখনই পরিচয়। হজরত আলীর মেয়ে আঁখিকে তার স্বামী ও তার শ্বশুরবাড়ির পরিবার নির্যাতন করে হত্যা করার পর এখন আত্মহত্যার গল্প সাজিয়ে আলামত গায়েব করে মিথ্যা মামলা সাজানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। হজরত আলী যখন বলেন, ‘টাকা নয়, আমার মেয়ের হত্যাকারীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার প্রাণ জুড়াইব না।’ তখন সাহস পাই নিজের ভেতর।

মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুরের কথা, যাঁর চোখ উপড়ে ফেলেছিলেন তাঁর স্বামী নিজে। অথচ অনেকে দোষ দিয়েছিলেন রুমানাকেই। মনে পড়ে, নেশায় আসক্ত ঐশীর কথা, যে নিজে নিজের বাবা-মাকে খুন করেছিল। এগুলোকে কেবল ঘরের ব্যাপার, ভালো পরিবারের শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। সমাজে ও রাষ্ট্রে যখন সহিংসতা থাকে; সমাজ ও রাষ্ট্র যখন নারীকে-নাগরিককে নিরাপত্তা-সম্মান দিতে পারে না, নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে পারে না, যখন চারদিকে চলে নৈরাজ্য আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তখন পরিবার আর আলাদা কিছু নয়। রাষ্ট্র ও সমাজের ভ্রূণ হিসেবে পরিবারেও ঘটতে থাকে সহিংসতা। এই সহিংসতা রুখতে নারীদের ঘরের কথা বাইরে আনতে হবে, আন্দোলন করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

একই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতিবাদের মুখে বাধ্য করতে হবে প্রচলিত সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলের জন্য। সন্দেহ নেই এর জন্য নারীকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে, নারী আন্দোলনে রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা। কিন্তু সমাজের অর্ধেক অংশ নারী-পুরুষ উভয়কেই এই আন্দোলনের অংশীদার হতে হবে। তা না হলে পারিবারিক সহিংসতা কেন, নারীর ওপর অন্য সব সহিংসতাও বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করা যাবে না নাগরিকদের ওপর সহিংসতাও।

লেখক: সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রী