Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশে নেলসন ম্যান্ডেলা

১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী সমাপনী অনুষ্ঠানে একই মঞ্চে (বাঁ থেকে) তখনকার রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান সুলেমান ডেমিরেল ও শেখ হাসিনা। ছবি: পাভেল রহমান

নেলসন ম্যান্ডেলা একবারই এসেছিলেন বাংলাদেশে। তখন তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মোহাম্মদ জমির। ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সে অভিজ্ঞতার কথাই তিনি বলেছেন অন্য আলোকে।

আমার ঘরের দেয়ালজোড়া ছবিতে রয়েছে আমার জীবনের নানা স্মৃতি। এর মধ্যে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সবচেয়ে ওপরের ছবিটি। নেলসন ম্যান্ডেলার ছবিটি অন্যগুলো থেকে আলাদা। কারণ, ছবিটি ম্যান্ডেলা নিজে আমাকে উপহার দিয়েছেন। তাঁর স্বাক্ষরসহ। ম্যান্ডেলার নিজ হস্তাক্ষরে সেখানে লেখা রয়েছে ‘মোহাম্মদ জমির, বেস্ট উইশেস টু আ ডিপেন্ডেবল ফ্রেন্ড’। নিচে তারিখ: ২৭.০৩.১৯৯৭।
সময়টা ১৯৯৭ সাল। মার্চের ২৬ তারিখ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী দিবস। বিশ শতকে মানুষের মুক্তির প্রতীক দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছেন। একই সময়ে এসেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান সুলেমান ডেমিরেলের মতো বিশ্বনেতা। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীকে তাৎপর্যময় করে তুলতে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে তাঁরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত শিখা চিরন্তন উদ্বোধন করবেন।
আমি তখন বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব। দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। রাষ্ট্রদূত আমার নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যান্ডেলা বলে উঠলেন, ‘আমি তাঁর নাম জানি।’ তারপর বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। এ রকম সুযোগ মানুষের জীবনে কবারই বা আসে!
সেই বিকেলেই ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গেলাম হোটেল শেরাটনে (বর্তমানে রূপসী বাংলা)। মনে উত্তেজনা কাজ করছিল। এত বড় মানুষ! মানবতার মুক্তির জন্য লড়াই ও সংগ্রামের এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা! কী কথা হবে?
ম্যান্ডেলার সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক মেয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত। কোনো ভণিতা ছাড়াই আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ তাঁর সৌজন্যে আমি তো বাক্যহারা।
১৯৭৯ সালের কথা। সে সময় আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ ডেস্কের পরিচালক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের চতুর্থ কমিটিতে বর্ণবৈষম্যমূলক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতো। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রধানের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ম্যান্ডেলার মুক্তির ব্যাপারে কথা হতো। কালো মানুষদের অধিকারের জন্য দীর্ঘ এক নৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যান্ডেলা। কিন্তু কখনো নীতিবোধ থেকে বিচ্যুত হননি এক তিলও। বাংলাদেশ থেকে আমরা তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম।
জাতিসংঘ ছাড়াও যেখানেই সুযোগ পেয়েছি, ম্যান্ডেলার মুক্তির আয়োজনে শামিল থেকেছি। ১৯৮২ সালে হেড অব মিশন হয়ে গিয়েছিলাম ব্যাংককে। সে বছরই ম্যান্ডেলাকে রোবেন দ্বীপ থেকে পোলসমুর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হলো। ব্যাংককে ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (স্ক্যাপ) সভায় আমরা ম্যান্ডেলার মুক্তির ব্যাপারে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলাম। এরপর বদলি হয়ে চলে যাই লন্ডনে। সেখানে কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটেও ম্যান্ডেলার অন্তরীণ থাকার বিষয়ে আমরা কথা বলি।
সারা দুনিয়ার অব্যাহত গণদাবির মুখে ১৯৯০ সালে অবশেষে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর তিনি জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। অজস্র মানুষ তাঁকে দেখতে এসেছিল। তিনি দূর থেকে সবাইকে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন। আমিও ছিলাম সেই ভিড়ে।

নেলসন ম্যান্ডেলা, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

ভাবতে অবাক লাগে, সেই আমি বসে আছি ম্যান্ডেলার একান্ত সান্নিধ্যে। বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। সেই অসুস্থ শরীর নিয়েও এখানে আসতে তিনি দ্বিধা করেননি। আমাকে বললেন, স্বাধীনতার জন্য বাঙালির যে আত্মত্যাগ, তিনি এসেছেন তার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ উপচে পড়ছিল। তিনি বিশেষ করে জানতে চাইছিলেন ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের কথা। ‘যে শরণার্থীরা ফিরে এসেছে, তারা ভালো আছে তো? তাদের ঠিকমতো পুনর্বাসন করা হয়েছে তো?’ এসব প্রশ্ন করছিলেন ফিরে ফিরে।
বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনার কথা বলছিলেন তিনি। বলেছিলেন, কিছু আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কিন্তু দেশটি পাল্টে যেতে পারে। এ জন্য দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নইলে দেশ মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ, স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতাও থাকবে না। তখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়বে। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন শিক্ষা-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও।
একপর্যায়ে ম্যান্ডেলা জানতে চাইলেন, আমি গান গাইতে পারি কি না। বললাম, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে আমি বেহালা বাজাতে শিখেছিলাম। শুনে তিনি শিশুর মতো হাসলেন। বললেন, ‘আমি গান খুব ভালোবাসি।’ পাশে বসে থাকা ম্যান্ডেলার মেয়েও তাঁর এ কথায় সায় দিল। ম্যান্ডেলা বললেন, ‘যাদের অন্তরে গান নেই, তারা তো মৃত।’ এরপর কী যেন ভেবে বললেন, ‘আমি কিন্তু ভালো নাচতেও পারি।’ তাঁর মেয়ে এবার হইহই করে উঠল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘বাবা, তুমি কিন্তু এখন আবার উঠে নাচতে শুরু করে দিয়ো না।’
কথা চলছিল বেশ আন্তরিক পরিবেশে। কিন্তু সেদিন বিকেলের আলো যেন একটু দ্রুতই ফুরিয়ে আসছিল। এবার বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত। ম্যান্ডেলা হঠাৎ আমের প্রসঙ্গ তুললেন। বললেন, তিনি আম খেতে খুব ভালোবাসেন। এখানে আমের মৌসুম কবে? আফসোসের সুরে বললাম, সে তো আরও মাস তিনেক বাকি।
ম্যান্ডেলা চলে যাবেন পরদিন, অর্থাৎ ২৭ মার্চ। সেদিনই আমার হাতে এল সেই অনন্য উপহার। দক্ষিণ আফ্রিকার কনসাল জেনারেল আমার হাতে তুলে দিলেন ম্যান্ডেলার স্বাক্ষর করা ছবিটি।
কী সৌভাগ্য আমার! শুধু আমার মনে নয়, মানবমুক্তির সৌভাগ্যের এই দূত বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানুষের হূদয়ে, চিরকাল।
অনুলিখন: সুচিত্রা সরকার