Thank you for trying Sticky AMP!!

বিয়ে নিয়েও প্রতারণা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঘটকের সঙ্গে হবু বর সেজে মো. গোলাম মোস্তফা নিজেই গিয়েছিলেন কনে দেখতে। এক দেখাতেই পছন্দ। বরের ভাই শান্তি মিশনে আফ্রিকার কোনো একটা দেশে আছেন। ফিরলেই বিয়ে। এই এক টুকরো খবরে কলাবাগানে কনেপক্ষের বাড়িতে শান্তির সুবাতাস বইতে লাগল।

তবে সুখ সুখ ভাবটা স্থায়ী হলো না। তিন মাসের মাথাতেই কলাবাগানের পরিবারটা বিপদ আঁচ করতে পারল। ওই একই সময়ে অবশ্য
উত্তরায় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক নারী কর্মকর্তারও মাথা খারাপ দশা। এখানেও পাত্রের নাম গোলাম মোস্তফা, ভাই আছেন শান্তি মিশনে। ফিরলেই বিয়ে। ধীরে ধীরে জানা গেল, এই একই ব্যক্তির কারণে ঢাকায় একই সময়ে রাগে-ক্ষোভে আর নিজেদের বোকামিতে বিরক্ত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে
১২-তে।

 বিয়ের কথা বলে সবার কাছ থেকে ধাপে ধাপে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। আর যাঁদের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে প্রতারণা করা হয়, ওই নারীদের সবাই উচ্চশিক্ষিত, কর্মজীবী। বয়স ৩৫-এর বেশি। সমাজ ও পরিবারের চাপে তাঁরা বিয়ের ব্যাপারে নমনীয় ভাব দেখিয়েছিলেন। সুযোগ বুঝে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বরবেশী প্রতারক।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গত জুনে ধরা পড়েছেন প্রতারক গোলাম মোস্তফা। সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার জিশানুল হক বলেন, গ্রেপ্তারের আগে তিনজন নারী রাজধানীর আলাদা তিনটি থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। পরে সিআইডিকে অভিযোগ জানান আরও ছয় নারী। আর ফোনে অভিযোগ করেন আরও তিনজন।

এখনো মেয়ের বিয়ে হয়নি?

উচ্চশিক্ষিত, অবিবাহিত তিন নারীর সঙ্গে বিয়ে ও প্রতারণার বিষয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। পরিবারের সদস্যরা আহত হতে পারেন—এই বিবেচনায় তাঁরা কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।

এই নারীদের একজন নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর ছয়েক আগে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন। এখন জমিয়ে ব্যবসা করছেন। বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, ভুলভাল সঙ্গীর সঙ্গে অশান্তির জীবন পার করার চেয়ে একা থাকা শ্রেয়। কিন্তু সমস্যা করে বৃহত্তর পরিবারের সদস্য আর প্রতিবেশীরা। একটার পর একটা উদ্যোগ সফল হওয়ার পরও তাঁর পরিবারকে শুনতে হয় ‘মেয়ের কোনো প্রবলেম’ আছে কি না। কেন বিয়ে করতে চায় না। তারপর তাঁরা নিজেরাই সমস্যা খুঁজতে বসে যান। এটা তাঁর জন্য ভীষণ যন্ত্রণার।

উচ্চশিক্ষিত আরেকজন জীববিজ্ঞানের একটি বিষয়ে স্নাতকোত্তরের পর সম্মানজনক বেতনে ভালো চাকরি করছেন। ছোট্ট ছিমছাম একটি বাসায় থাকেন। দুঃখ করে বলছিলেন, এত কথা শুনতে হয় যে তাঁকে আত্মীয়স্বজনের চাপে উচ্চমাধ্যমিক পাস ছেলের সামনে গিয়েও বসতে হয়েছে। বিয়ে তিনি করতে চান না—বিষয়টা এমন নয়, কিন্তু তাঁরও পছন্দ-অপছন্দ আছে। আর এ প্রসঙ্গ এলেই তাঁকে শুনতে হয় তিনি খুঁতখুঁতে, নিজের দোষে বিয়ে হচ্ছে না ইত্যাদি। তাঁর বা পরিবারের লোকদের চেয়ে অন্যদের চিন্তাই তাঁর ব্যাপারে বেশি বলে মনে হয়।

আরেকজন নারী বলছিলেন, ৩০ পেরোলেই বিয়ের বয়স চলে গেছে—এটা সমাজের চাপিয়ে দেওয়া একটা ধারণা। সেই সমাজ এত শক্তিশালী যে মাঝেমধ্যেই নারীরা নতিস্বীকার করে ফেলেন। অনেক সময় অবিবাহিত নারীদের নিরাপত্তার ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে পরিবার। নারী তখন বিয়েতে সম্মতি দিয়ে ফেলেন।

প্রতারণার ধরন

গোলাম মোস্তফাকে দিয়েই শুরু করা যাক। কলাবাগানের সেই এনজিওকর্মী থানায় যে অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাতে লিখেছেন, হবু বর পরিচয়ে তাঁদের বাসায় এসেছিলেন তিনি। বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার পর একদিন ওই প্রতারক তাঁকে ফোন করে বলেন, সরল বিশ্বাসে কিছু লোককে সহযোগিতা করতে গিয়ে তিনি বিপদে পড়ে গেছেন। তাঁকে ওএসডি করা হয়েছে।

অর্থসংকটের কারণে তিনি বদলির জন্য তদবির করতে পারছেন না। একবার বদলি হতে পারলেই তাঁর অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যাওয়া একরকম নিশ্চিত। পরিবারের সিদ্ধান্তে প্রথমে ১৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর নয় দফায় পাঁচ লাখ টাকা ও তিন ভরি স্বর্ণ দেন। ৩১ মে এসে দেখেন গোলাম মোস্তফার ফোন বন্ধ। সেই ফোন আর কখনো খোলেননি তিনি।

>* রংপুরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা আদতে এসএসসি পাস।
* বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা কামানোই গোলাম মোস্তফার কাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর শিকার উচ্চশিক্ষিত ও মধ্য–তিরিশ পেরোনো নারীরা।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রংপুরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা আদতে এসএসসি পাস। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা কামানোই তাঁর কাজ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর শিকার উচ্চশিক্ষিত ও মধ্য–তিরিশ পেরোনো নারীরা। তিনি তিনটি কথা বলে লাজুক ভঙ্গিতে টাকা চাইতেন। তিনি ওএসডি হয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর পেছনে লেগেছে আর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চান। একজনের কাছ থেকে তিনি ৫৮ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন। এ কাজে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনজন ঘটকও। গোলাম মোস্তফা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে উত্তরায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকতেন। এখন কারাগারে আছেন।

এমন ঘটনা আরও আছে। সিআইডিরই এক কর্মকর্তা বলছিলেন, পুলিশ পরিচয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকেই প্রতারণার চেষ্টা করেছেন এক ব্যক্তি। ওই ভুয়া পুলিশ আবার নিজেকে সিআইডি কর্মকর্তার ব্যাচের বলে দাবি করেছিলেন। খোঁজ নিতে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এল। দেখলেন, এ সেই ছেলে, যিনি চাকরিতে যোগদানের পর ওরিয়েন্টেশনের দিন কীভাবে যেন নতুন নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত মিলনায়তনে ঢুকে পড়েছিলেন। বেশ কটি ছবি তুলে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। বিয়ের জন্য তিনি যে ছবি দিয়েছেন, সেটি ওই ওরিয়েন্টশন অনুষ্ঠানের দিনই তোলা।

একজন চিকিৎসকের বিমানে কর্মরত বন্ধু প্রতারিত হয়েছেন সম্প্রতি। ছেলেটি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়ার কিছুদিন পর জানা যায়, তিনি বিদেশে চলে গেছেন, সেখানে স্ত্রীও আছে তাঁর। মাঝখান থেকে বিমান কর্মকর্তার গচ্চা গেছে লাখ দশেক টাকা।

ভেবেচিন্তে বিয়ে

উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীদের অনেকেই মনে করছেন, নারীরা যতটা এগোচ্ছেন, সমাজ এগোচ্ছে না সেভাবে। তাঁরা এখনো প্রথাগত ধারণা নিয়ে রয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, ক্ষমতায়িত নারীদের গ্রহণ করার মানসিকতা সমাজে সেভাবে তৈরি হয়নি। এমনকি নারীর বাবা বা ভাইয়েরাও এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী নন যে একজন স্বনির্ভর নারী যখন খুশি নিজের পছন্দে বিয়ে করবেন। আবার অন্যটাও দেখা যায়, নারী যখন ক্রমে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগোতে থাকেন, অনেক রকম ভয় পেয়ে বসে তাঁকে। হয়তো তত দিনে তাঁর বাবা মারা গেছেন বা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, ভাইয়েরা সেভাবে পাশে নেই। তিনি ভাবেন, রাষ্ট্র তাঁর পাশে বৃদ্ধ বয়সে দাঁড়াবে না। ব্যাংকে যা কিছু জমিয়েছেন, হয়তো সেগুলোও হাতছাড়া হয়ে যাবে। সবকিছু মিলে তিনি নমনীয় হয়ে যান। ভুল সিদ্ধান্ত বা প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন।