Thank you for trying Sticky AMP!!

বুকে শুধুই শূন্যতার হাহাকার

অলংকরণ: আরাফাত করিম

যশোরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন চার্চ স্কুল থেকে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে শিশু বের হতো, সবাইকেই মনে হতো শামারুখ মাহজাবীন। বাবা নুরুল ইসলাম শেষমেশ একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওখানটাতেই দাঁড়াতে। শামারুখ শুনত না। রোজ লুকিয়ে থাকত, বাবা খুঁজে পেলেই হাসিতে লুটিয়ে পড়ত, তারপর ঝাঁপ দিয়ে উঠে পড়ত কোলে।

শামারুখ নেই আজ ছয় বছর। ২০১৩ সালের নভেম্বরে তাকে খুন করা হয়েছে নাকি আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়েছে, সে বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।

কিন্তু তাই বলে নুরুল ইসলামের রুটিন বদলায়নি। রোজ ব্যাপ্টিস্ট মিশন চার্চ স্কুলের সামনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। অদৃষ্টের সঙ্গে কথা বলেন, তর্ক জোড়েন। সিনেমার ফিতার মতো শামারুখের জীবনটা রিওয়াইন্ড করেন, কখনো এক জায়গায় স্থির করে রাখেন, আবার শুরু থেকে দেখেন।

নুরুল ইসলাম আসলে একা নন। বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে হারিয়ে যাওয়া কন্যাকে খুঁজে ফিরছেন অসংখ্য মা–বাবা।

শামারুখ মাহজাবীন। ছবি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) নারীদের ওপর কত ধরনের নির্যাতন হয়, তার একটা হিসাব রাখে। আসকের হিসাবে ২০১৫ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ২১২ জন নারী, স্বামীর পরিবারের হাতে ৪০ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৫৫ জন। ওই একই বছর ধর্ষণের পর খুন হয়েছেন ৬০ জন, আত্মহত্যা করেছেন আরও ২ জন। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত স্বামীর হাতে খুনের শিকার হয়েছেন ১৭৩ জন। স্বামীর পরিবারের হাতে ৩৭ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৪৭ জন। যৌতুকের কারণে এই একই সময়ে শারীরিক নির্যাতনের কারণে খুন হয়েছেন ৭৮ জন, আর এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। ধর্ষণের পর ৬২ জন খুন হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। কঠোর আইন, মানুষকে সচেতন করতে প্রচারপত্র, পোস্টার, বিলবোর্ড—কোনো কিছুই বাঁচতে দেয়নি এই নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার মেয়েদের। আর এই মেয়েদের মা–বাবারা বেঁচে আছেন শূন্যতার হাহাকার নিয়ে।

মামলার খসড়া লিখে রেখেছেন মিতুর বাবা

বিয়ের দিনে মাহমুদা খানম। ছবি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

তোয়ালে পেঁচিয়ে যশোর ফাতেমা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শাহেদা মোশাররফের কোলে তুলে দিয়েছিলেন মাহমুদা খানম ওরফে মিতুকে। শাহেদা, তাঁর স্বামী মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া মেয়ের মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। ৩৫ বছর পর তাঁরাই ছয় বছরের নাতিকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘মায়ের শরীরটা চাদরে ঢেকে দাও।’ মাহমুদার চোখ দুটি তখনো বোজা, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তাঁরা জেনে গেছেন মেয়ে আর নেই।

সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খুন হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। অভিযোগের তির যায় বাবুল আক্তারের দিকে। তিন বছর ধরে ঝুলে আছে মামলাটি। কবে পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দেবে, কেউ জানে না।

তবে মাহমুদার বাবা মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া একটা মামলার খসড়া লিখে রেখেছেন। সময় পেলেই ঘষামাজা করেন তাতে। যদি কোনো দিন মিতু হত্যার অভিযোগপত্র পুলিশ আদালতে জমা দেয় আর তাতে বাবুল আক্তারের নাম না থাকে, তিনি আদালতে যাবেন এই কাগজটা হাতে করে। রাজধানীর ভূঁইয়াপাড়ার বাসায় গেলে কাগজটা ধরিয়ে দিলেন মোশাররফ। এর পরতে পরতে মেয়ের বিবাহিত জীবনে কষ্টের কাহিনি লেখা। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব চেপে গিয়েছিলেন মাহমুদা।

গত তিনটি বছর শাহেদা মোশাররফ আর মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া একটা প্রশ্নেরই জবাব খোঁজেন, তাঁদের মেয়ে কেন খুন হলেন? স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না? হাতের জড়ুলটা? যেটা প্লাস্টিক সার্জারির পরও রয়ে গিয়েছিল, সেটার কারণে বাবুল বিরক্ত ছিলেন? কিন্তু তাই বলে খুন?

মাহমুদার ছোট বোন চিকিৎসক শায়লা মোশাররফ বলেন, দুই দফায় তাঁর বাবার সঙ্গে বাবুল আক্তারের বাবা চাকরি করেছেন। দুজনই পুলিশ সদস্য ছিলেন। এসএসসি পাসের পর মাহমুদার সঙ্গে বাবুল আক্তারের বিয়ে হয়। বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার পাওয়ার পর থেকেই বলতে শুরু করেন, মাহমুদা অশিক্ষিত, সবার সামনে উপস্থাপনযোগ্য নয়।

অন্ধকারে ডুবে আছে তনুর বাসা

সোহাগী জাহান তনু। ছবি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

কুমিল্লা সেনানিবাসে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ খুন হয়েছিলেন কলেজছাত্রী ও সংস্কৃতিকর্মী সোহাগী জাহান তনু। তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ফোনে বললেন, দুই ছেলের পর একটিই মেয়ে। নিজের বোন ছিল না। মা মারা গেছেন বহুদিন। তনুই পূরণ করেছিল সব অভাব।

ইয়ার হোসেন বলছিলেন, তনুর জন্ম মুরাদনগরে। তিনি সেনানিবাসে ছোটখাটো চাকরি করতেন, থাকতেন মেসে। সাড়ে তিন বছর বয়সে তনুকে নিয়ে তাঁর মা আনোয়ারা বেগম পাকাপাকিভাবে স্বামীর কাছে চলে এলেন। তখন থেকে তিনি ছিলেন মা–বাবার সব আনন্দের উৎস।

ইয়ার হোসেন বলেন, ‘তনু পাঁচ বছর বয়সে নাচ শিখতে গেল। গান গাইত। পরে নাটক করত। তনু নাচলে আমরা হাতে তালি দিতাম। গান গাইলে খুশি হইতাম। কী যে চঞ্চল ছিল সে। এখন ঘর অন্ধকার। নূপুরের আর শব্দ নাই, হারমোনিয়াম বাজে না।’

সোহাগী জাহান খুনের তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গত দুই বছরে একবারের জন্যও ইয়ার হোসেন বা আনোয়ারা হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি সিআইডি। সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুধু বলেন, তদন্ত চলছে।

ইয়ার হোসেন শুধু বলেন, তিনি এমন নদীতে পড়েছেন, যেখানে না আছে কূল, না একটা সেতু। একটা খড়কুটোও নেই যে আঁকড়ে ধরবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বাবা–মা কন্যা হত্যার বিচার পেলে হয়তো কিছুটা শান্তি পেতেন।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বললেন, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে আইন, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু শুধু আইন তৈরি করে বসে থাকলে চলবে না; আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে না। এর প্রয়োগে যতগুলো পক্ষ আছে, প্রতিটি পক্ষকে নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।